ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ , চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন

ম্যালেরিয়া একটি সংক্রামক রোগ। প্রত্যেক বছর প্রায় ৫১.৫ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১০-৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায় এই রোগে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই আফ্রিকার শিশু। ম্যালেরিয়া প্লাজমোডিয়াম বর্গের এককোষীও পরজীবি দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে।
 

তার মধ্যে শুধুমাত্র ৪ ধরনের প্লাজমোডিয়াম পরজীবি মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম ও প্লাজমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স।

ম্যালেরিয়া: মশা প্রাণী দেহে বিভিন্ন প্রকার রোগ সৃষ্টি করে থাকে। এইসব রোগ কে মশাবাহিত রোগ বলা হয়। মশা বাহিত সংক্রামক ভয়াবহ রোগ গুলোর মাধ্যমে ম্যালেরিয়া অন্যতম। এটি অনেক সময় মারাত্মক ব্যাধি হয়ে দাঁড়ায়। ম‍্যলেরিয়া শব্দটি সর্বপ্রথম ১৭৫১ সালে বিজ্ঞানী টর্টির ব্যবহৃত শব্দ।

ইতালিয় শব্দ Mal (অর্থ- দূষিত) ও aria (অর্থ- বায়ু) হতে Malaria (ম‍্যালেরিয়া) শব্দটি এসেছে। তখন মানুষ মনে করতো দূষিত বায়ু সেবনে এ রোগ হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মতে, প্রতিবছর ২০ কোটির বেশি মানুষ ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ২০১০ সালে ৬,৬০,০০০ থেকে ১.২ মিলিয়ন মানুষ ম্যালেরিয়া রোগে মারা যায়। এদের অধিকাংশই ছিল আফ্রিকার শিশুরা।

২০১১ সালের, ৯৯টি দেশের একটি রিপোর্ট অনুসারে ম্যালেরিয়া সংক্রমণের কারণে ১,০৬,৮২০ জনের মৃত্যু হয়। ম্যালেরিয়া সারা বছরই হতে পারে তবে নাতিশীতোষ্ণ অর্থাৎ বর্ষাকালে ম্যালেরিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ম্যালেরিয়া ক্রান্তীয় অঞ্চল, ‌উপ‌-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি দেখা যায় কারণ বৃষ্টিপাত, উষ্ণ তাপমাত্রা, এবং স্থির জল হল মশার ডিমের জন্য আদর্শ আবাসস্থল।

ম্যালেরিয়া হলো প্রোটোজোয়া পর্বের Plasmodium গণভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতি দ্বারা সৃষ্ট মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণীর দেহে সৃষ্ট মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এর মূলে রয়েছে Plasmodium গোত্রের Protista। এটা অ্যানোফিলিক মশকী দ্বারা সংক্রমিত রোগ। স্ত্রী অ্যানোফিলিক মশকী ছাড়া এ রোগের বিস্তার সম্ভব নয়।

স্ত্রী অ্যানোফিলিক মশা তাদের ডিম পরিপক্কের জন্য মানুষের রক্ত গ্রহণ করে থাকে। কামড়ানোর সময় মানুষের দেহে প্রবেশ করে ম্যালেরিয়ার পরজীবী । যা প্রটিস্টার মাধ্যমে মানুষের রক্তের ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে যকৃতে প্রবেশ করে। এভাবেই সংক্রমিত হয় ম্যালেরিয়া রোগ। ম্যালেরিয়া রোগের প্রধান লক্ষণ হলো কাঁপুনি সহ জ্বর।

Plasmodium গণের প্রায় ৬০ প্রজাতি আছে যা মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীদেহে ম্যালেরিয়া রোগ সৃষ্টির করে। এরমধ্যে মাত্র ৫ টি প্রজাতির মানুষের দেহে ম্যালেরিয়া রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম। যথা:

  • Plasmodium falciparum: এই রোগের নাম ম্যালিগন্যান্ট টারশিয়ান ম্যালেরিয়া এতে ৩৬ থেকে ৪৮ ঘন্টা পর পর জ্বর আসে, সুপ্তাবস্থা কাল ৮ থেকে ১৫ দিন।
  • Plasmodium malariae: এই রোগের নাম কোয়ারটান ম্যালেরিয়া এতে ৭২ ঘন্টা পর পর জ্বর আসে, সুপ্তাবস্থা কাল ১৮ থেকে ৪০ দিন।
  • Plasmodium vivax: এই রোগের নাম বিনাইন টারশিয়ান ম্যালেরিয়া এতে ৪৮ ঘন্টা পর পর জ্বর আসে, সুপ্তাবস্থাকাল ১২ থেকে ২০ দিন।
  • Plasmodium ouale: এই রোগের নাম মৃদু টারসিয়ান ম্যালেরিয়া এতে ৪৮ ঘন্টা পর পর জ্বর আসে, সুপ্তাবস্তা কাল ১১ থেকে ১৬ দিন।
  • প্লাজমোডিয়াম নলেসি

ম্যালেরিয়ার লক্ষণ বা উপসর্গ : মানবদেহে ম্যালেরিয়া জীবাণু প্রবেশের ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। লক্ষণগুলো হলো :

  • প্রচন্ড তাপ (১০৪°-১০৫° ফারেনহাইট) ও কাঁপুনিসহ জ্বর আসা।
  • শীত শীত ভাব হওয়া ও পেশির খিঁচুনি হওয়া।
  • মাথা ব্যথা ও বমি বমি ভাব হওয়া।
  • কিছুক্ষণ পর পর প্রচুর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে।
  • আবার নির্দিষ্ট সময় পর পর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে।
  • জ্বর ৩-৪ ঘন্টার স্থায়ী হয় এবং জ্বর আসার পূর্ব পর্যন্ত দেহে বাড়তি তাপমাত্রা থাকে না।
  • পরিপাকে ব্যাঘাত ঘটে।
  • রোগী দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • প্লীহা ও যকৃত স্ফীত হয়।
  • রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।
  • অনিদ্রা।

এসব লক্ষণের পাশাপাশি অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের জটিল লক্ষন দেখা দেই। যেমন: শ্বাস কষ্ট, জন্ডিস ও কিডনি বিকলগ্ন হওয়া। এর পাশাপাশি অনেক সময় গ্লুকোজের ঘাটতিও দেখা দেয়। এসব ক্ষেত্রে রোগী মৃত্যু মুখেও ঢলে যেতে পারে। শিশু, বয়স্ক সবাই ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। শিশু ও অল্প বয়স্কদের ক্ষেত্রে এ রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে ।

মশকীর দংশন ছাড়াও আরো কিছু কারণে ম্যালেরিয়ার বিস্তার ঘটে থাকে। যেমন: কোন গর্ভবতী যদি ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তার গর্ভের সন্তানেরও ম্যালেরিয়া হবার সম্ভাবনা থাকে। কোন সুস্থ ব্যক্তি যদি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করে তাহলে উক্ত ব্যক্তিও এরোগে আক্রান্ত হয়ে যায়।


ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ: ম্যালেরিয়া জ্বর একটি "মারাত্মক ব্যাধি" রূপে সর্বাধিক পরিচিত।ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সকল ব্যবস্থা গৃহীত হয় তাদেরকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

মশক কুলের ধ্বংস সাধন: অ্যানোফিলিক মশার ধ্বংস সাধনের জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় তা হলো:

  1. প্রজনন ক্ষেত্রে ধ্বংস সাধন : অ্যানোফিলিক মশার প্রজননের জন্য পানি অপরিহার্য। কোন প্রকারেই বদ্ধ জলাশয়ের সৃষ্টি হতে দেওয়া যাবে না। অগভীর ও বদ্ধ জলাশয় গুলোতে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। মুক্ত নালা সমূহ কে ঢেকে রাখতে হবে।
  2. মশার লার্ভার ধ্বংস সাধন : বদ্ধ জলাশয় গুলোতে যেখানে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা নেই সেখানে পানির উপর কেরোসিন, পেট্রোলিয়াম বা প্যারাপিন তেল ঢেলে দিয়ে পানির উপর আস্তরণ তৈরি করা যাতে লার্ভা গুলো অক্সিজেনের অভাবে শ্বসন প্রক্রিয়া চালাতে না পেরে মারা যায়। DDT, DDD এবং বেনজাইল হাইড্রোক্লোরাইড রাসায়নিক পদার্থ পানিতে স্প্রে করে ধ্বংস করা যায়। ট্রাপ সৃষ্টি করে এবং নিজে হাতেও লার্ভা ধ্বংস করা যায়।

মশার দমনের হাত হতে আত্মরক্ষা : দংশন ছাড়া স্ত্রী অ্যানোফিলিক মশা সংক্রমিত করতে পারে না তাই দংশনের হাত হতে রক্ষা করতে পারলে কোন ব্যক্তি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হবে না। যেসব পদক্ষেপগুলো নেওয়া যায় তা হলো:

  • যেসব এলাকায় ম্যালেরিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেসব এলাকায় যাওয়ার সময় সমস্ত শরীর ঢাকা জামা পরা।
  • সন্ধ্যার পরে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করা।
  • ঘরের দরজা জানালায় তারজালি ব্যবহার করা।
  • সন্ধ্যার পূর্বে ঘরের মধ্যে অ্যারোসল জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে করে মশকী দূর করা।
  • ঘুমানোর সময় মশারি বা কয়েল ব্যবহার করা।
  • মশার আক্রমণ থেকে বাঁচতে মশা প্রতিরোধক ক্রিম বা লোশন এবং স্প্রে ব্যবহার করা।
  • ঘরের দেয়ালে ক্রিসোট নামক রাসায়নিক দ্রব্যের সাহায্যে রং করা যাতে এর গন্ধে মশা পালিয়ে যায়।
  • বাড়ির আশেপাশে, বাগানে, ছাদে বা কোন ফুলের টবে যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা।

ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা: ম্যালেরিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি উক্ত উপসর্গ গুলো দেখা দিলে তার দেহের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া রোগ সনাক্ত করা যায়। ম্যালেরিয়া একটি নিরাময় যোগ্য রোগ। সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময় করা সম্ভব।

পূর্বে সিনকোনা গাছের ছাল হতে প্রস্তুতকৃত কুইনাইন ম্যালেরিয়া রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে কুইনাইন ছাড়াও আরো অনেক ওষুধ বের হয়েছে যেমন: ক্লোরোকুইন, সেফলোকুইন, হ্যালোফ্যানট্রিন, প্রিইমাকুইন, ফ্যানমিডার, আর্টিসেথার ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করে একজন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগী আরোগ্য লাভ করতে পারে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগারের জিহাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন;

comment url