তামাদি আইন ধারা: ৬ — আইনগত অক্ষমতা ( অপারগতা)_সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন

  • যেক্ষেত্রে মকদ্দমা বা কার্যধারা দায়ের করার বা ডিক্রি জারির জন্য দরখাস্ত দাখিলের অধিকারী ব্যক্তি, যে সময় হতে তামাদি মেয়াদ গননা করতে হবে সে সময় নাবালক,পাগল বা জড়বুদ্ধি সম্পন্ন থাকে সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি তার অপারগতার অবসান হওয়ার পর, অপারগতা না থাকলে প্রথম তফসিলের তৃতীয় কলামে বা দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ৪৮ ধারায় বর্ণিত যে মেয়াদের মধ্যে সে তা করতে পারতো সেই মেয়াদের মধ্যে মামলা বা কার্যধারা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিল করতে পারবে।
  • যে সময় হতে তামাদি মেয়াদ গননা করতে হবে, সেই সময় যদি দুটি অপারগতাই পতিত হয় বা যেক্ষেত্রে তার অপরগতার অবসান হওয়ার পূর্বেই সে আরেকটি অপারগতায় পতিত হয় তাহলে উভয় অপরগতার অবসান হওয়ার পর উপরে বর্ণিত যে মেয়াদের মধ্যে সে তা করতে পারতো সেই মেয়াদের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিল করতে পারবে।
  • যে ক্ষেত্রে এরূপ ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত তার অপারগতা অব্যাহত থাকে, সেক্ষেত্রে তার আইনগত প্রতিনিধি ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর, অপারগতা না থাকলে ওপরে বর্ণিত যে মেয়াদের মধ্যে যেত সেই মেয়াদের মধ্যে মামলা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিল করতে পারবে।

বিশ্লেষণ

তামাদি আইনের ৬ ধারায় একটি সাধারন নীতি তুলে ধরা হয়েছে। আর এই নীতি হল, তামাদি মেয়াদ গননা করার সময়ে বাদী বা দরখাস্তকারী যদি আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে তামাদি মেয়াদ চলতে পারেনা। তাদের এরূপ অক্ষমতার অবসান না হওয়া পর্যন্ত তামাদি মেয়াদ স্থগিত থাকবে। তাদের এই রূপ অক্ষমতা বা অপারগতার অবসানের পর তামাদি মেয়াদ শুরু হবে। 

কিন্তু এই অক্ষমতা বা অপারগতা যদি তামাদি মেয়াদ শুরু হওয়ার পর আরম্ভ হয় তাহলে ৬ ধারার বিধান কার্যকর হবে না। কারণ, ৯ ধারায় বলা হয়েছে যে একবার তামাদি মেয়াদ অতিবাহিত হওয়া শুরু করলে পরবর্তীতে কোন অপারগতা বা অক্ষমতা দ্বারা তা বন্ধ করা যাবে না।

উদাহরণ

  • ক তার নাবালক থাকাকালে একটি নৌকার ভাড়া আদায়ের জন্য মামলা করার অধিকার পাই। এর চার বছর পর সে সাবালক হয়। সাবালক হওয়ার তারিখ হতে তিন বছরের মধ্যে যেকোনো সময় সে তার মোকদ্দমা দায়ের করতে পারবে।
  • ই নাবালক থাকাকালে একটি মকদ্দমা করার অধিকার পাই। এই অধিকার লাভের পর, সে নাবালক থাকাকালে পাগল হয়ে পড়ে। তার পাগল অবস্থা ও নাবালকত্ব অবসানের তারিখ হতে ই-এর বিরুদ্ধে তামাদি মেয়াদ চলতে থাকবে।

তামাদি স্থগিত রাখার উদ্দেশ্যাবলী

১৯০৮ সালের তামাদি আইন অনুসারে নালিশের কারণ উদ্ভব হওয়ার সময় হতে তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হয়। আর এই ৬ ধারা সাধারণ নিয়মের একটি ব্যতিক্রম। এ ধারা অনুসারে নালিশের কারণ উদ্ভব হতে তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হয় না, পরবর্তীতে শুরু হয়। ৬ ধারা মতে, তামাদি মেয়াদ গননা করার সময়ে বাদী বা দরখাস্তকারী যদি আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ হয়, তাহলে তার এ রূপ অক্ষমতার অবসান না হওয়া পর্যন্ত তা আমাদের মেয়াদ স্থগিত থাকবে। এবং তারে অক্ষমতার অবসান হওয়ার পরেই তামাদি মেয়াদ গণনা করা হবে।

উদ্দেশ্য নিচে উল্লেখ করা হলো —
  1. আইনগতভাবে অক্ষম বা অযোগ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে তামাদি প্রয়োগ না করা। কারণ, অক্ষম বা অযোগ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে তামাদি প্রয়োগ করা যায় না।
  2. আইনগতভাবে অক্ষম বা অযোগ্য ব্যক্তি, অর্থাৎ - নাবালক, পাগল বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বা জড়বুদ্ধির সম্পন্ন ব্যক্তিগণের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করা।
  3. প্রথম হতে তামাদি মেয়াদকে কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত রাখা। অক্ষমতার অবসান হওয়ার পরেই তামাদি মেয়াদ চলতে শুরু করে। কিন্তু তা আমাদের মেয়াদ একবার চলা শুরু করলে তার স্থগিত রাখা যায় না।
  4. মোকদ্দমা বা কার্যধারা দায়ের করার কিংবা ডিক্রি জারির জন্য দরখাস্ত দাখিলের অধিকারী ব্যক্তির যদি আইনগতভাবে অক্ষম বা অযোগ্য হয় তাহলে তার প্রতিকার লাভের জন্য অতিরিক্ত সময় দেওয়া।
  5. এই ধারা অনুসারে নাবালক, পাগল বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বা জড় বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির সুস্থ হওয়ার পর মোকদ্দমা বা কার্যধারা দায়ের বা ডিক্রি জারির জন্য দরখাস্ত দাখিল করতে পারবে।
  6. আইনগতভাবে অক্ষম বা অযোগ্য ব্যক্তিকে তার প্রতিকার লাভের সুযোগ প্রদান করা, যাতে তাদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয়।

যে সকল ক্ষেত্রে ৬ ধারা প্রয়োগযোগ্য 

  1. তামাদি আইনের প্রথম তফসিলে উল্লেখিত মূল মোকদ্দমার ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য।
  2. ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের প্রথম তফসিলের উল্লেখিত আবেদন পত্র বা দরখাস্তের মাধ্যমে শুরু হওয়া মূল কার্য-ধারার ডিক্রি বা আদেশ জারের দরখাস্তের ক্ষেত্রে প্রয়োগ যোগ্য।
  3. তামাদি আইনের প্রথম তফসিলে উল্লেখিত মূল মোকদ্দমা এবং আবেদন পত্র বা দরখাস্তের মাধ্যমে শুরু হওয়া মূল কার্যধারার ডিক্রি বা আদেশ জারির দরখাস্তের ক্ষেত্রে প্রয়োগ যোগ্য।
  4. দেওয়ানী কার্যবিধির ৪৮ ধারা অনুসারে ডিক্রি জারির দরখাস্ত যে ক্ষেত্রে বারিত সেইক্ষেত্রে প্রয়োগ যোগ্য।
  5. তামাদি আইন দ্বারা তা আমাদের মেয়াদ নির্ধারিত থাকলে ৬ ধারা প্রয়োগ যোগ্য হবে।

যে সকল ক্ষেত্রে ৬ ধারা প্রয়োগ যোগ্য নয় 

  1. আপিলের ক্ষেত্রে তামাদি আইনের ৬ ধারা প্রয়োগ যোগ্য নয়। ( 21 DLR WP 140)।
  2. আপিলের অনুমতির আবেদনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ যোগ্য নয়।
  3. রিভিশণ এর ক্ষেত্রে ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ৬ ধারা প্রয়োগ যোগ্য নয়।
  4. অন্য কোন আইন দ্বারা তামাদি মেয়াদ নির্ধারিত থাকলে সেই ক্ষেত্রে ৬ ধারা প্রয়োগ যোগ্য নয়।
  5. একতরফা ডিক্রি বাতিলের আবেদনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ যোগ্য নয়।
  6. রোয়েদাদ দাখিল করার আবেদনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ যোগ্য নয়।
  7. ডিক্রি জারির মাধ্যমে বিক্রয় বাতিলের আবেদনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ যোগ্য নয়।

বৈধ বা আইনগত অপারগতা বা অক্ষমতা ( Legal Disability) 

বৈধ বা আইনগত অপারগতা বা অক্ষমতা হলো এমন অপারগতা বা অক্ষমতা যার জন্য কোন ব্যক্তি তামাদি আইনের ৬ ধারা অনুসারে মামলা- মোকদ্দমা করতে পারে না বা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনা। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে কোন তামাদি মেয়াদ চলতে পারে না। তাই তারা বৈধ বা আইনগত অপারগ বা অক্ষম ব্যক্তি।

তামাদি আইন এর ৬(১) ধারায় ২টি অপারগতাকে বৈধ বা আইনগত অপরগতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অপারগতা দুটি হল —
  • নাবালক হওয়া এবং
  • জড়বুদ্ধি সম্পন্ন বা পাগল হওয়া।
অপারগতা বা অক্ষমতা অবশ্যই চলমান থাকবে ( Disability must be initial, not subsequent) :

তামাদি আইনের ৬ ধারা প্রযোজ্য হওয়ার জন্য অপারগতা বা অক্ষমতা অবশ্যই চলমান থাকতে হবে। সুতরাং, একবার শুরু হলে তা চলতেই থাকতে হবে। শুরু হয়ে থেমে থেমে চললে হবে না। একবার থেমে গেলে তামাদি মেয়াদ অতিবাহিত হওয়া শুরু হবে। কারণ, ৯ ধারা অনুসারে একবার তামাদি মেয়াদ অতিবাহিত হওয়া শুরু করলে পরবর্তীতে কোন অপারগতা বা অক্ষমতা দ্বারা তা বন্ধ বা স্থগিত হবে না।

নালিশের কারণ ( Cause of action) : নালিশের বা মামলার কারণ ( Cause of action) মামলা করার অধিকারের সমর্থক ( 41 DLR 500)। যে ঘটনা কোন ব্যক্তিকে মামলা করার অধিকার দেয় তাকে নালিশের কারণ বা মামলার কারণ ( Cause of action) বলে। নালিশের কারণ একটি অন্যায় কাজ, For Example - অন্যের জায়গায় অনধিকার প্রবেশ করা। অর্থাৎ - কোন ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া তার জায়গায় প্রবেশ করাকে অনধিকার প্রবেশ বলে।

আবার নালিশের কারণ অন্যায় কর্মজনিত ক্ষতি, For Example - অবহেলার কারণে যে ক্ষতি হয়। আইনগত অধিকার লঙ্ঘিত হলে নালিশের কারণ উদ্ভব হয়। দেওয়ানী কার্যবিধির ২ আদেশের ৩/৪ বিধিতে নালিশের কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে।

উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তঃ 34 DLR 219 — অগ্রক্রয় মামলার তামাদি মেয়াদ - অধিকার অর্জিত হওয়ার ৭ বছর পর কোন নাবালক কন্যার মা, যার হস্তান্তর সম্পর্কে জ্ঞান ছিল, তার পক্ষ হতে অগ্রক্রয়ের মামলা করলে নাবালকের অজুহাত টিকবে না। এক্ষেত্রে অভিভাবক হিসাবে মায়ের জ্ঞান নাবালক কন্যার জ্ঞান হিসেবে বিবেচিত হবে।

21 DLR WP 140— আপিলের ক্ষেত্রে ৬ ধারা প্রয়োগ যোগ্য নয়, অর্থাৎ আপিল দায়ের করার জন্য নাবালক বা অন্য অযোগ্য ব্যক্তি ৬ ধারার বিধানের সুবিধা নিতে পারবে না।

6 DLR 152 — মাতৃ গর্ভে থাকা শিশু ৬ ও ৮ ধারার সুবিধা নিতে পারে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগারের জিহাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন;

comment url