আপীল, রিভিশন, রিভিউ ও রেফারেন্স

আমাদের আজকের আলোচনায় থাকবে আপিল সংক্রান্ত বিধানাবলী


আপিল

আপীল ( Appeal) : আপীল হল একপ্রকার আবেদন যা এক পক্ষ উচ্চ আদালতে পেশ করে নিম্ন আদালতের রায় বাতিল বা বদল করার জন্য।

অন্যভাবে বলা যায়, appeal means the right of carrying a particular case from an inferior to superior court with a view to ascertaining whether the judgement is sustainable or not. It is considered to be the continuation of the trial of the Lower court.

কোন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোন আদালতে আপিল দায়ের করতে হয় —

দেওয়ানী আপিল: যে সকল আদালতের আপিল এখতিয়ার আছে —
  • জেলা জজ আদালতে এবং
  • হাইকোর্ট বিভাগ
যখন যে আদালতে আপিল আবেদন দায়ের করতে হয় —

ক) অতিরিক্ত জেলা জজ ও জেলা জজ আদালতের ডিক্রির বিরুদ্ধে সব সময় আপিল করতে হবে হাইকোর্ট বিভাগে এবং যুগ্ম জেলা জজ আদালত যদি এমন ডিক্রি প্রদান করেন যার মূল্যবান পাঁচ কোটির বেশি তাহলে সেই বিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে হাইকোর্ট বিভাগে ;

খ) যুগ্ম জেলা জজের পাঁচ কোটি টাকার নিচের কোন ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে জেলা জজ আদালতে ;

গ) সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ এর ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে জেলা জজ আদালতে।

কত দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে —
  • হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করতে হবে ডিক্রি প্রদানের তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে ; এবং
  • জেলা জজ আদালতে আপিল করতে হবে ডিক্রি প্রদানের তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে।
ফৌজদারী মামলায় আপিল সংক্রান্ত বিধান —

ফৌজদারি মামলায় আপিল আলোচনা করা হয়েছে পিসির ৪০৪ থেকে ৪৩১ ধারায়।

কোন কোন ক্ষেত্রে আপিল চলে না 

(ক)আসামি যদি নিজের দোষ নিজে স্বীকার করে নেয়। ( ধারা ৪১২) ;

Note : এখানে দন্ডের পরিমাণ ও আইনগত যৌক্তিকতা প্রশ্নে যদি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তাহলে আপিল করা যাবে।

(খ) দায়রা আদালত যদি ১ মাসের কম কারাদণ্ডাদেশ দেন। (ধারা৪১৩) ;

(গ) ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট যদি ৫০ টাকার কম জরিমানা করেন। (ধারা ৪১৩) ;

(ঘ) শাস্তি যদি কারাদণ্ড না হয় ;

(ঙ) জরিমানা অনাদায়ে কারাদণ্ড হয়;

(চ) সামারি ট্রায়াল হয় অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্ষেত্রে জরিমানা ২০০ টাকার কম হয় । (ধারা ৪১৪) ;

তবে, এক্ষেত্রে আপিল করা যায় যদি এই জরিমানা অন্য কোন দণ্ডের সাথে যুক্ত থাকে ; এবং

(ছ) নালিশী মামলা খারিজ হলে আপিল চলেনা।

এগুলোর বিরুদ্ধে আপিল না চললে প্রতিকার কি? 

সুতরাং, আমরা জানি যেখানে আপিল চলে না সেখানে রিভিশন করা যায়। অর্থাৎ, রিভিশনই হচ্ছে প্রতিকার।

কোন আদালতের বিরুদ্ধে কোথায় আপিল করা যাবে —

ক) তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এবং

খ) প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, এমন কি যুগ্ম দায়রা জজ আদালত যদি পাঁচ বছরের কম কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করেন তাহলে তার বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে দায়রা জজ আদালতে।

তবে, এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে — খালাস আদেশের বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হয় দায়রা জজ আদালতে এবং দায়রা জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হয় হাইকোর্ট বিভাগে। ( ধারা ৪১৭)

বিঃদ্র: এখানে বলা হয়েছে জি আর মামলা অর্থাৎ জেনারেল রেজিস্ট্রার মামলায় ২য় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট থেকে দায়রা আদালত পর্যন্ত সকল আদালত দন্ডাদেশের ও অপর্যাপ্ততার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অর্থাৎ পাবলিক প্রশিকিউটর হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়ের করতে পারবে। 

কিন্তু সি আর মামলায় অভিযোগকারী অপর্যাপ্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আদালতে অর্থাৎ, দায়রা আদালতে আপিল করতে পারবে।

সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, জি আর মামলায় আপিল করতে পারবে শুধু মাত্র সরকার পক্ষের আইনজীবী অর্থাৎ, পাবলিক প্রসিকিউটর।

এবং সি আর মামলায় আপিল করতে পারবে অভিযোগকারী এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অর্থাৎ পাবলিক প্রসিকিউটর উভয়ই।

ফৌজদারী মামলায় কি দ্বিতীয় আপিল করা যায়? —

ফৌজদারী মামলায় খালাস আদেশের বিরুদ্ধে পাবলিক প্রসিকিউটর দ্বিতীয়বার আপিল করতে পারেন। কিন্তু অভিযোগকারী খালাস আদেশের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার আপিল করতে পারেন না।

আপেল কখন বাতিল হতে পারে —

৪৩১ ধারায় বলা হয়েছে যে, খালাস বা অপর্যাপ্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল বাতিল হবে। কিন্তু, সেটা যদি জরিমানা বা অর্থ আদায়ের মামলা হয় তাহলে আপিল কারীর মৃত্যু হলেও আপিল বাতিল হবে না। আপিলকারীর প্রতিনিধিরা স্থলাভিষিক্ত হবেন।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মূল আদালত যে দণ্ড দিতে পারতো আপিল আদালত কখনো তা অপেক্ষা বেশি দণ্ড দিতে পারবে না।

কত দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে —

ক) মৃত্যুদণ্ডের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে ৭ দিনের মধ্যে। কিন্তু The Special Powers Act, 1974 এর অধীনে মৃত্যুদণ্ডের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে হয় ৩০ দিনের মধ্যে।

খ) মৃত্যুদণ্ডাদেশ ব্যতীত অন্যান্য দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করতে হয় ৬০ দিনের মধ্যে এবং দায়রা জজ আদালতে আপিল করতে হয় ৩০ দিনের মধ্যে।

গ) খালাস আদেশের বিরুদ্ধে সি আর মামলায় অভিযোগকারী আপিল করতে সময় পান ৬০ দিন এবং জেনারেল রেজিস্ট্রেড মামলায় পাবলিক প্রসিকিউটার আপিল করতে সময় পায় ৬ মাস।

Note : আপিলের সাথে রায় বা আদেশের নকল জমা দিতে হবে। এবং আপিলকারী কারাগারে থাকলে কারাগারের ভারপ্রাপ্ত অফিসারের নিকট আপিলের দরখাস্ত পেশ করতে হবে। (ধারা ৪১৯)

রিভিশন

রিভিশন হলো উচ্চতর আদালতের পূর্ণ বিবেচনামূলক প্রতিকার। উচ্চতর আদালত কর্তৃক ব্যবহৃত নিম্ন আদালতের প্রতি তদারকি করার ক্ষমতা কে বলা হয় রিভিশন।

যে ডিক্রী বা আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন দায়ের করা যায়—

মূল মামলা বা আপিলে প্রদত্ত যে সকল আদেশ বা ডিক্রীর বিরুদ্ধে আপীল দায়ের করা যায় না সে সব আদেশ বা ডিক্রীর বিরুদ্ধে রিভিশন দায়ের করা যায়।

কে রিভিশন দায়ের করতে পারে—

দেওয়ানী আদালতের ডিক্রী বা আদেশ সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি রিভিশনের জন্য আবেদন দায়ের করতে পারে।

যে কারণে রিভিশন দায়ের করা যায় —

দেওয়ানী আদালতের সিদ্ধান্তের বিষয়ে রিভিশন মামলা দায়ের এর প্রধান কারণ হলো দেওয়ানী আদালতের আইনগত ভুল সনাক্ত করে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

যে সকল আদালতের রিভিশন এখতিয়ার আছে —

দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ১১৫ ধারা অনুযায়ী দুই ধরনের আদালতের রিভিশন আছে লাভ করতে আসছে। যথা -
  • হাইকোর্ট বিভাগ ;এবং
  • জেলা জজ আদালত।
যখন যে আদালতে রিভিশন আবেদন দায়ের করতে হয় —

ক.জেলা জজ আদালত বা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতের ডিক্রী বা আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে ;

খ.সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ এবং যুগ্ম জেলা জজ আদালতের ডিক্রীর বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে ;

গ.সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ এবং যুগ্ম জেলা জজ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে জেলা জজের নিকট।

তবে শর্ত থাকে যে, রিভিশন করা যাবে সে সকল ডিক্রী বা আদেশের বিরুদ্ধে যার বিরুদ্ধে আপীল চলে না এবং ডিক্রী বা আদেশটি মূল মামলায় বা আপীল মামলায় প্রদত্ত হতে হবে।

ফৌজদারি রিভিশন 

ফৌজদারি মামলায় রিভিশন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে ৪৩৫ থেকে ৪৪২ ধারায়।

ফৌজদারি মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ এবং দায়রা আদালতের রিভিশন প্রয়োগ করার ক্ষমতা আছে। সুতরাং, হাইকোর্ট বিভাগ এবং দায়রা জজ আদালত —

ক.কোনো দন্ড বা আদেশের নির্ভুলতা ;

খ.সিদ্ধান্তের বৈধতা বা যৌক্তিকতা ; এবং

গ. কার্যক্রমের নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে কিনা তার জন্য নিম্ন আদালতের নথি তলব করতে পারেন।(ধারা-৪৩৫)

নথি তলব চলাকালীন সময়ে আদালত আসামির শাস্তি স্থগিত এবং জামিনে বা মুচলেকায় মুক্তি দিতে পারে।

আপিলের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের যে ক্ষমতা রিভিশনের ক্ষেত্রেও হাইকোর্ট বিভাগ একই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। (ধারা -৪৩৯)

হাইকোর্ট বিভাগ রিভিশনের ক্ষেত্রে যা যা ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে একই ক্ষমতা দায়রা আদালতও করতে পারে। এই একটা ক্ষেত্রে যেখানে হাইকোর্ট বিভাগ এবং দায়রা জজ আদালতের ক্ষমতা এক। 

অর্থাৎ দায়রা জজ আদালতে একবার রিভিশন করলে হাইকোর্ট বিভাগ ৪৩৯ ধারার ক্ষমতা প্রয়োগ করে দ্বিতীয়বার রিভিশনের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। সুতরাং বলা যায়, ফৌজদারি আদালতের দ্বিতীয় রিভিশনের কোন সুযোগ নেই । দায়রা আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। (ধারা -৪৩৯ক)

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কোন রিভিশন ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ তাদের কাছে রিভিশনের আবেদন করা যায় না।

কোন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোন আদালতে রিভিশনের আবেদন করতে হবে —

ক.সকল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিশন করতে হবে দায়রা আদালতে ; এবং

খ.দায়রা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিশন করতে হবে হাইকোর্ট বিভাগে।

কত দিনের মধ্যে রিভিশনের দায়ের করতে হয় —

ক.হাইকোর্ট বিভাগে আবেদনকারী রিভিশন দায়ের করার জন্য সময় পাবে ৬০ দিন ; এবং

খ.দায়রা জজ আদালতের রিভিশনের তামাদির মেয়াদ ৩০ দিন।

রিভিউ 

রিভিউ হলো কিছু নির্দিষ্ট এবং নির্দেশিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার পুন:নিরীক্ষণ।

রিভিউ এবং রিভিশনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে রিভিউ দায়ের করা হয় ডিক্রী প্রদানকারী আদালতে। এবং রিভিশন দায়ের করা হয় ডিক্রী প্রদানকারী আদালতের রিভিশন ক্ষমতা সম্পন্ন উচ্চ আদালতে।

যে সকল ক্ষেত্রে রিভিউ আবেদন করা যায় —
  • যে সকল ডিক্রী বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের বিধান নেই ;
  • যে সকল ডিক্রী বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের বিধান আছে কিন্তু আপিল করা হয়নি ; এবং
  • স্মল কজেজ আদালতের রেফারেন্সের প্রদত্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।
রিভিউ করার কারণ 
  • যদি মোকদ্দমা সম্পর্কের নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় আবিষ্কার হয় ;
  • যদি মোকদ্দমার নথিতে কোন সুস্পষ্ট ভুল দেখা যায় ;এবং
  • অন্য কোন যুক্তিযুক্ত কারণে।
কত দিনের মধ্যে রিভিউ দায়ের করতে হয় —

ডিক্রী বা আদেশ জারীর তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে।

রেফারেন্স  

দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ধারা ১৩ ও আদেশ ৪৬ এ রেফারেন্স সম্পর্কে বিধান করা হয়েছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগারের জিহাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন;

comment url