রাতে ঘুমানোর পূর্বে বিশেষ কিছু আমল ও তার ফজিলত সম্পর্কে জেনে নিন
ঘুম হলো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে পাওয়া একটি নেয়ামত ও অনুগ্রহ। ক্লান্তি দূর করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ঘুম। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমাদের নিদ্রাকে করেছি, ক্লান্তি দূরকারী।’ (সুরা নাবা, আয়াত : ০৯) তবে ঘুমানোর পূর্বে কিছু বিশেষ আমল করলে ঘুমানোর পর থেকে জাগ্রত হওয়া পর্যন্ত সময় কেউ আল্লাহ তাআলা ইবাদত দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেন।
রাতে ঘুমানোর পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ আমলগুলোর হাদিসসহ ফজিলত বা উপকার নিচে বর্ণনা করা হলো
ওযু করা: রাতে ঘুমানোর পূর্বে অজু করে শরীর পবিত্র করে নেওয়া দুনিয়া এবং আখেরাতের জন্য কল্যাণকর। এ সম্পর্কে হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি রাতে আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করে ও অজু করে নিদ্রা যায় এবং রাতের গভীরে জেগে আল্লাহর কাছে দুনিয়া-আখিরাতের কোনো ধরনের কল্যাণ প্রার্থনা করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে সেটি দান করেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৪২)
পাত্র ঢাকা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে ঘুমানোর পূর্বে পাত্রে ঢেকে রাখা নেই দেশ দিয়েছেন। সেহেতু রাতে ঘুমানোর পূর্বে পাত্র ঢেকে রাখা আমাদের জন্য ফজিলতপূর্ণ। জাবের থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘(রাতে ঘুমানো আগে) তোমরা পাত্র ঢেকে দাও, পানির মশকের মুখ বেঁধে দাও, দরজাগুলো বন্ধ করে দাও, প্রদীপ নিভিয়ে দাও।
কেননা, শয়তান মুখ বাঁধা মশক খুলে না, বন্ধ দরজাও খুলে না এবং পাত্রের ঢাকনাও উম্মুক্ত করে না। সুতরাং তোমাদের কেউ যদি পাত্রের মুখে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ঢেকে রাখার জন্য কেবল একটি কাষ্ঠখণ্ড ছাড়া অন্য কিছু না-ও পায়, তাহলে সে যেন তাই করে। কারণ ইঁদুর ঘরের লোকজনসহ ঘর পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।’ (রিয়াদুস সালিহিন, হাদিস : ১৬৫৪)
বিছানা ঝাড়া: মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমস্ত কাজ করা নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলোর পেছনে বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে যা বিভিন্ন গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত। আর রাতে ঘুমানোর পূর্বে বিছানা ঝেড়ে ঘুমানো কারণ হলো বিছানায় ক্ষতিকার পোকামাকড় থাকতে পারে। ঘুমানোর পূর্বে বিছানা ঝাড়া উচিত। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যদি তোমাদের কেউ শয্যায় যায়, তখন সে যেন তার জামা দিয়ে বিছানাটা ঝেড়ে নেয়।
কারণ সে জানে না যে তার অনুপস্থিতিতে বিছানার ওপর পীড়াদায়ক কোনো কিছু ছিল কি না। তারপর এই দোয়া পড়বে, হে আমার রব! আপনারই নামে আমার শরীরটা বিছানায় রাখলাম এবং আপনারই নামে আবার উঠব।’(বুখারি, হাদিস : ৬৩২০)
সুরমা লাগানো: ঘুমানোর পূর্বে দুই চোখে তিনবার করে সুরমা লাগানো সুন্নত। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.)-এর একটি সুরমাদানি ছিল। প্রতি রাতে (ঘুমানোর আগে) তিনি ডান চোখে তিনবার এবং বাঁ চোখে তিনবার সুরমা লাগাতেন।’ (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস : ৪১)
আয়াতুল কুরসি পাঠ করা: রাতে ঘুমানোর পূর্বে আয়াতুল কুরসি পাঠ করা অনেক বেশি ফজিলতপূর্ণ। কারণ আয়াতুল কুরসি শয়তান থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে। বিশ্বনবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তুমি যখন শয্যা গ্রহণ করবে, তখন আয়াতুল কুরসি পড়বে।
তাহলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তোমার জন্য একজন রক্ষক থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার কাছে আসতে পারবে না’। (বুখারি, হাদিস: ২৩১১)
সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়া: সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়লে জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য এটি যথেষ্ট হবে। মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাকারার শেষ দুইটি আয়াত তেলাওয়াত করবে, তার জন্য তা (সব সমস্যার সমাধানে) যথেষ্ট হবে’। (বুখারি, হাদিস: ৫০৪০)
সুরা মুলক পড়া: সুরা মুলক এমন একটি সূরা যা হাশরের ময়দানে আল্লাহ তায়ালার কাছে সুপারিশ করবে। আর কবরের আযাব থেকে রক্ষা করবে। তাই বলা যায়, সুরা মুলক অনেক বেশি ফজিলতপূর্ণ। রাসুল (সা.) বলেছেন, কোরআনের মধ্যে ৩০ আয়াতবিশিষ্ট একটি সুরা আছে, যেটি কারো পক্ষে সুপারিশ করলে তাকে মাফ করে দেওয়া হয়। সুরাটি হলো তাবারাকাল্লাজি বিয়াদিহিল মুলক (সুরা মুলক)। (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯১)
আল্লাহর নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যাক্তি প্রত্যেক রাতে তাবারকাল্লাযী বিইয়াদিহিল মুলক (সুরা মূলক) পাঠ করবে, এর মাধ্যমে মহিয়ান আল্লাহ্ তাকে কবরের আজাব থেকে রক্ষা করবেন।’ ( তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯০)
হজরত জাবির (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) সূরা মুলক না পড়ে ঘুমাতেন না’। (মিশকাত)
তিন কুল পড়া: রাতে ঘুমানোর পূর্বে তিন কুল পড়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ তিন কুল শয়তান থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রাতে যখন বিছানায় যেতেন, তখন দুই হাত একত্র করে তাতে সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁ দিতেন। অতঃপর মাথা ও চেহারা থেকে শুরু করে যত দূর সম্ভব দেহে তিনবার দুই হাত বোলাতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০১৭)
সূরা কাফিরুন পড়া: প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘রাতে (কুল ইয়া আইয়্যু হাল কা-ফিরুন) (অর্থাৎ সুরা কা-ফিরুন) পাঠ করা শিরক থেকে মুক্তি পেতে উপকারী।’ (সহিহ তারগিব, হাদিস : ৬০২)
সূরা ইখলাস পড়া: সূরা ইখলাস এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ এতে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় পাওয়া যায়। একবার আল্লাহর রাসুল (সা.) তার সাহাবাদের বললেন, ‘তোমাদের কেউ কি এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কোরআন পড়তে অসমর্থ হবে?’ এতে সকলকে বিষয়টি ভারী মনে করল। বলল, এই কাজ আমাদের মধ্যে কে পারবে— হে আল্লাহর রাসুল!? তখন তিনি বললেন, ‘সুরা ইখলাস হলো- এক-তৃতীয়াংশ কোরআন। (বুখারি, হাদিস : ৫০১৫)
তাসবি পড়া: মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘আমি কি তোমাদের উত্তম জিনিসের সন্ধান দেবো না? যখন তোমরা বিছানায় যাবে, তখন ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবর’, ৩৩ বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ এবং ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম প্রতিদান’। (বুখারি)
আল্লাহর রাসুল (সা.) তার মেয়ে ও জামাতা ফতেমা (রা.) ও হযরত আলী (রা.)- কে বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন কিছু বলে দেবো না? যা তোমাদের জন্য খাদেম অপেক্ষাও উত্তম হবে? যখন তোমরা তোমাদের বিছানায় যাবে, তখন তোমরা (৩৩) বার সুবহানাল্লাহ, (৩৩) বার আলহামদুলিল্লাহ্ এবং (৩৪) বার আল্লাহু আকবার বলবে; তা খাদেম অপেক্ষাও তোমাদের জন্য উত্তম হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৭০৫)
ঘুমানোর পূর্বে দোয়া পড়া: রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শোয়ার পর আল্লাহর নাম নেয় না, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে লাঞ্ছনা নেমে আসবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৫৬)
আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন ঘুমানোর ইচ্ছা করতেন, তখন তার ডান হাত— তার গালের নীচে রাখতেন, তারপর এ দোয়াটি বলতেন—
ﺍﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺑِﺎﺳْﻤِﻚَ ﺃَﻣُﻮﺕُ ﻭَﺃَﺣْﻴَﺎ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমু-তু ওয়া আহ্ইয়া
অর্থ : হে আল্লাহ্! আপনার নাম নিয়েই আমি মরছি (ঘুমাচ্ছি) এবং আপনার নাম নিয়েই জীবিত (জাগ্রত) হব। (বুখারি, হাদিস : ৬৩২৪)
আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদত করার জন্য। আর মানুষ ঘুমালে আল্লাহর ইবাদত করতে পারে না। তবে ভালো তায়ালা এতটাই দয়ালু, করুণাময়ী, যে এ সময়টাতেও তিনি আমাদেরকে সাওয়াব পাওয়ার ও তাকে সন্তুষ্ট করার পথ করে দিয়েছেন। ঘুমানোর পূর্বে উক্ত আমল গুলো করে ঘুমের মাঝেও সাওয়াব পেতে পারি। আল্লাহ আমাদের সকলকে আমল গুলো করার তৌফিক দান করুন। (আমীন)
ব্লগারের জিহাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন;
comment url