কোন কোন ধরনের মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু বলা হয় বিস্তারিত জেনে নিন
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন , ‘প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৮৫, সুরা আম্বিয়া : ৩৫, সুরা আনকাবুত : ৫৭) । পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই; যদিও তোমরা সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর। -(সুরা নিসা, আয়াত, ৭৮)
আল্লাহ তাআলার স্বয়ং নিজে বলে দিয়েছেন যে প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুবরণ করতে হবে অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে বা প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তবে সবার মৃত্যু একরকম হবে না। কেউ পাবে শহীদি মর্যাদার মৃত্যু আবার কেউ পাবে স্বাভাবিক মৃত্যু।
আল্লাহ তাআলা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বলেছেন, ‘আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।’ (সুরা আনআম : ১৬২)
একজন মুমিনের সকল কাজ কর্ম হওয়া উচিত আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, ‘তিনি জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন।’ (সুরা তাওবা : ১১১)।
মুমিন ব্যক্তিদের কামনা-বাসনা হওয়া উচিত শহীদি মৃত্যু। কারণ, মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল অথচ জিহাদ করেনি এমনকি মনে জিহাদের তথা শহীদি মৃত্যুর চিন্তাও করেনি, সে যেন মুনাফেকির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল। (সহিহ মুসলিম)
শহীদি মৃত্যু দুই ধরনের। এক নাম্বার হলো প্রকৃত শহীদ। যারা আল্লাহর দ্বীন কায়েম করার জন্য কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজের প্রাণ হারিয়েছেন তাদেরকে প্রকৃত শহীদ বলা হয়। প্রকৃত শহীদের মর্যাদা অনেক বেশি। তাদের মর্যাদা এত বেশি যে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে জীবিত ঘোষণা করেছেন।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না।’ (সুরা আল-বাকারা : ১৫৪)
অন্য এক আয়াতে এসেছে, তারা রবের পক্ষ থেকে রিজিকপ্রাপ্ত। (সুরা ইমরান: ১৬৯)
দুই নাম্বার হলো হুকুমী শহীদ। যারা বিভিন্ন মহামারিতে, পীড়ায়, আঘাতে ইত্যাদিতে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের হুকুমী শহীদ বলা হয়। এদের কেউ শহীদের মর্যাদা দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। এরাও শহীদের সওয়াব প্রাপ্ত হবে। তবে প্রকৃত শহীদ ও হুকুমী শহীদের মধ্যে পার্থক্য হলোপ্রকৃত শহীদকে গোসল ছাড়ায় কবর দেওয়া হয় কিন্তু হুকুমী শহীদদের গোসল ও জানাজা করার পর কবর দেওয়া হয়।
তবে শহীদি মৃত্যুর পূর্ব শর্ত হচ্ছে মুমিন হতে হবে। ইসলামে ঈমান ছড়া শহীদি মর্যাদা পাওয়া সম্ভব নয়। ইসলামে শহীদি মৃত্যু সবচেয়ে বেশি মর্যাদার। তাই শহীদি মৃত্যুকে অন্যান্য মৃত্যুর সমপরিমাণ মর্যাদার ভাবা থেকে নিষেধ করেছেন।
এ সম্পর্কে ইরবাদ ইবনে সারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, শহীদ ও বিছানায় মৃত্যুবরণকারী আল্লাহ তাআলার সঙ্গে মহামারিতে মৃত্যুবরণকারীর ব্যাপারে বিতর্ক করে। শহীদ বলে, আমাদের ভাইয়েরা আমাদের মতোই মৃত্যুবরণ করেছে, সুতরাং তাদের আমাদের মতো মর্যাদা দান করুন। আর বিছানায় মৃত্যুবরণকারীরা বলবে আমাদের ভাইয়েরা আমাদের মতো মৃত্যুবরণ করেছে।
সুতরাং তাদের আমাদের মতো সম্মান দেওয়া হোক। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, মহামারিতে মৃত্যুবরণকারীদের আঘাতের দিকে তাকাও। যদি শহীদদের আঘাতের মতো তাদের আঘাত থাকে, তাহলে তারা শহীদের মর্যাদা পাবে। অতঃপর দেখা যাবে যে মহামারিতে মৃত্যুবরণকারীদের আঘাত শহীদদের আঘাতের মতো। ফলে তাদের শহীদের মর্যাদা দেওয়া হবে (মুসনাদ আহমদ, নাসারী, মিশকাত : হাদিস : ১৫৯৬)
জাবের (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মহামারি থেকে দূরে থাকা, ভয় করা, পালানোর চেষ্টা করা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানোর মতো। অর্থাৎ কবিরা গুনাহ। যে ব্যক্তি মহামারিতে মৃত্যুবরণ করল অথবা ধৈর্যধারণ করল সে শহীদের সমান পুণ্য লাভ করবে। (মুসনাদ আহমদ, মিশকাত : ১৫৯৭)
আবদুল্লাহ ইবনে জাবের রা. তার বাবার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বাবা জাবের রা.-কে তার রোগশয্যায় দেখতে গেলেন। তার কাছে গিয়ে দেখলেন নারীরা কেঁদে কেঁদে বলছে, আমরা মনে করেছিলাম, তুমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে।
তখন মহানবী সা: বলেন, আল্লাহর রাস্তায় শহীদ না হলে তোমরা কাউকে শহীদ মনে করো না? এমন হলে তো তোমাদের শহীদের সংখ্যা অতি অল্পই হবে। আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তি শহীদ, পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি শহীদ, আগুনে পুড়ে মৃত ব্যক্তি শহীদ, পানিতে ডুবে মৃত ব্যক্তি শহীদ, কোনো কিছুর নিচে চাপা পড়ে মৃত ব্যক্তি শহীদ, নিউমোনিয়াজাতীয় কঠিন পীড়ায় মৃত ব্যক্তি শহীদ, যে নারী গর্ভাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে সেও শহীদ। (আবু দাউদ: ৩১১১)
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শহীদ পাঁচ প্রকার। যেমন—১. প্লেগ বা মহামারিতে মৃত্যুবরণকারী, ২. পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারী, ৩. পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকারী, ৪. কুপে পড়ে মৃত্যুবরণকারী ও ৫. আল্লাহর রাস্তায় শহীদ (বুখারি ও মুসলিম)
জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহর রাস্তায় নিহত হওয়া ছাড়া শহীদ সাতজন। যেমন—১. প্লেগে মৃত্যুবরণকারী, ২. পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকারী, ৩. আঘাতে মৃত্যুবরণকারী, ৪. পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারী, ৫. আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণকারী, ৬. কূপে পড়ে মৃত্যুবরণকারী ও ৭. সন্তান প্রসব যন্ত্রণায় মৃত্যুবরণকারী নারী। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। (ইবনে মাজাহ)
জাবের বিন আতিক (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করা ছাড়াও সাত প্রকার শহীদ রয়েছে।
- মহামারীতে মৃত্যুবরণকারী শহীদ।
- পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকারী শহীদ।
- শয্যাশায়ী অবস্থায় মৃত শহীদ।
- পেটের রোগে মৃত্যুবরণকারী শহীদ।
- আগ্নিদগ্ধ ব্যক্তি শহীদ।
- যে ব্যক্তি ধ্বংসাবশেষের নিচে পড়ে মারা যায় সেও শহীদ।
- সন্তান প্রসব করতে মারা যাওয়া নারীও শহীদ।
(মুয়াত্তা মালিক: ৫৫৪, ৮০২, আল মুজামুল কাবির: ১৭৮০, সহিহ কুনুজু সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ: ২৩)
সাঈদ বিন যায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ, যে নিজের পরিবার রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ, যে তার নিজের প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ এবং যে নিজের দীন রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সেও শহীদ। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৭৪)
ব্লগারের জিহাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন;
comment url