জিলহজ্ব মাসের প্রথম ১০ দিনের ফজিলত ও বিশেষ আমল সম্পর্কে জেনে নিন
জিলহজ মাস হলো হজ্জ ও কোরবানির মাস। আরবি মাসের সর্বশেষ মাস জিলহজ। এই মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে হজের কার্যক্রম সম্পূর্ন হয়। জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখ সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ আরাফার ময়দানে একত্রিত হয়। পরের দিন সারা বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করে। দুনিয়ার সেরা আত্মত্যাগের মাস জিলহজ।
জিলহজ মাসেই হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কোরবানির মাধ্যমে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তাঁর এ ধারা অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহ জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করেন। যা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে । এ কারণেই এ মাস এতো বেশি ফজিলতপূর্ন ও মর্যাদাসম্পন্ন।
জিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিনের ফজিলত-
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা যেন নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর স্মরণ করে।’ (সুরা হজ : আয়াত ২৮)
মুফাসসির সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, এ নির্দিষ্ট দিনসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন।’ এ দিনগুলা এতটা মর্যাদার ও ফজিলতপূর্ণ যে, আল্লাহ তায়ালার স্বয়ং এ দিন গুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করতে বলেছেন।
কুরআনুল কারিমের সুরা ফাজরে প্রথম দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শপথ ভোরবেলার! শপথ ১০ রাতের!’
তাফসিরে ইবনে কাসিরে উল্লেখ করা হয়েছে এ ১০ রাতের শপথ দ্বারা জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনই উদ্দেশ্য। এ আয়াত দ্বারা আল্লাহ তায়ালা জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনকে সম্মানিত করেছেন।
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে এ দিনগুলোর আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল বেশি প্রিয় নয়। সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? উত্তরে নবিজী বললেন, ‘না’, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে হ্যাঁ যদি কোনো ব্যক্তি নিজের জান ও মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বের হন এবং সে কোনো কিছু নিয়ে ফিরে না আসেন। (বুখারি)
জিলহজ মাসের দিনগুলো এতটা মর্যাদার যে, ৯ জিলহজ হজ কারী সমস্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা নিষ্পাপ হিসেবে কবুল করে নেন।
জিলহজ মাসের ৯ জিলহজ দিবাগত রাতকে মুজদালিফার রাত বলা হয়। এ রাতে আল্লাহ তাআলা শবে কদরের রাতের চেয়েও বেশি মর্যাদা দিয়েছেন। এ রাতে ইবাদত বন্দেগী কারী যদি জুলুম করীও হয় তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দেন।
মুসনাদে আহমদে এসেছে, ‘জিলহজ মাসের প্রথম দশকের শেষ দুদিন অর্থাৎ ‘ইয়াওমে আরাফা ও ইয়াওমে নাহর (কোরবানির দিন) হওয়ায় তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’ জিলহজ মাসের মর্যাদা এতো বেশি হওয়ার অন্যতম দুটি কারণ হলো এ মাসের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হজ ও কোরবানি করা হয়।
জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমলের ফজিলত জিহাদের চেয়েও মর্যাদাবান। হাদিসে এসেছে হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এ দিনগুলোর (জিলহজের প্রথম ১০ দিনের) আমলের তুলনায় কোনো আমল-ই অন্য কোনো সময় উত্তম নয় । তারা বলল : জিহাদও না ? তিনি বললেন : জিহাদও না, তবে যে ব্যক্তি নিজের জানের শঙ্কা ও সম্পদ নিয়ে বের হয়েছে, অতঃপর কিছু নিয়েই ফিরে আসেনি।’ (বুখারি)
জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের বিশেষ আমল-
চুল ও নখ না কাটা: প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা কোরবানি করবে, তারা যেন (এই ১০ দিন) চুল ও নখ না কাটে।’ (মুসলিম: ৫২৩৩, ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা: ২২৭)। )
হজরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমরা জিলহজ মাসের চাঁদ দেখতে পাবে এবং তোমাদের কেউ কোরবানি করার ইচ্ছা করে তবে সে যেন চুল নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। (মুসলিম, ইবনে হিব্বান)
এক সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি বলুন, ‘(যদি আমার কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য না থাকে) কিন্তু আমার কাছে এমন উট বা বকরি থাকে, যার দুধ পান করা বা মাল বহন করার জন্য তা প্রতিপালন করি। আমি কি তা কোরবানি করতে পারি?’ তিনি বললেন, ‘না। বরং তুমি (১০ জিলহজ) তোমার মাথার চুল, নখ, গোঁফ কেটে ফেল এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করো। এই আল্লাহর কাছে তোমার কোরবানি।’ (আবু দাউদ, নাসাঈ, ত্বহাবি, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা: ৩০৫)।
রোজা রাখা: ঈদের দিন অর্থাৎ ১০ জিলহজ ব্যতীত জিলহজ মাসের প্রথম দশকে রোজা রাখা অনেক বেশি ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। হাফসা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো চারটি আমল পরিত্যাগ করেননি। সেগুলো হল: আশুরার সওম, যিল হজের দশ দিনের সওম, প্রত্যেক মাসে তিন দিনের সওম, ও ফযরের পূর্বের দুই রাকাত সালাত। (আহমদ: ৬/২৮৭, আবু দাউদ: ২১০৬, নাসায়ী: ২২৩৬)
আরাফার দিনে রোজা রাখা: ৯ জিলহজ আরাফার দিন রোজা রাখলে গুনাহ মাফ হয়। এই দিন ও রাত আল্লাহর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দিনটি হলো আরাফাতের ময়দানে সমবেত হওয়ার দিন। আর এ রাতটি হলো মুজদালিফায় (শবে কদরের মতো গুরুত্বপূর্ণ) অবস্থানের রাত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি আরাফার দিনের রোজা রাখবে আল্লাহ তাআলা তার এক বছর আগের এবং এক বছর পরের সব ছোট গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ (মুসলিম, মিশকাত)
রাতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করা: জিলহজ মাসের প্রথম ৯ দিনে রোজা রাখা এবং রাতে ইবাদত বন্দেগী করার সুন্নত। রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘জিলহজ মাসের প্রথম দশকের নেক আমল আল্লাহর নিকট যত বেশি প্রিয় আর কোনো দিনের আমল তাঁর কাছে তত প্রিয় নয়।
সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন, জিহাদও কি এই দশকের আমল থেকে উত্তম নয়? তিনি বললেন, না, আল্লাহর পথে জিহাদও এই দশকের আমলের তুলনায় উত্তম নয়, তবে ওই ব্যক্তির যে নিজের জান ও মাল নিয়ে বেরিয়ে গেল এবং শেষে কিছুই ফিরে এল না।’ (বুখারি, পৃষ্ঠা: ১৩২)
তাকবিরে তাশরিক পড়া: আইয়ামে তাশরিক তথা জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর একবার তাকবির বলা ওয়াজিব। পুরুষগণ স্বাভাবিক স্বরে, আর নারীগণ নিম্ন স্বরে তাকবির বলবেন। তাকবির হলো, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ (ইলাউস সুনান, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা: ১৪৮)
জিলহজ মাসের পাঁচ দিন ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর পড়া ওয়াজিব। চাই নামাজ একা আদায় করা হোক বা জামাতে। তাকবিরে তাশরিক আদায় করা। নারীদের তাকবিরের শব্দ যেন (গাইরে মাহরাম) অন্য লোকে না শোনে। তাকবিরে তাশরিক হলো-
اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ وَ اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر وَ للهِ الْحَمْد
উচ্চারণ : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’
অর্থ : ’আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; সব প্রশংসা মহান আল্লাহ জন্য।’
হজ্জ করা: এ মাসের বিশেষ আমল হলো- আর্থিক ও শারীরিক সক্ষম ব্যক্তিদের ওজর আপত্তি না দেখিয়ে হজ আদায় করা।
কোরবানি করা: সামর্থবান ব্যক্তিদের কুরবানী করা উচিত। জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ যেকোনো দিন, কোনো ব্যক্তির মালিকানায় নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা বা এর সমমূল্যের সম্পদ থাকলে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। পুরুষ ও নারী—সবার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য। (ইবনে মাজাহ: ২২৬)
প্রত্যেক মুসলমানের উচিত জিলহজ্ব মাসের মর্যাদাপূর্ণ দশ দিনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কাজে লাগানো। আর সামর্থ্যবান মমিনদের উচিত হজ্জ ও কোরবানির বিধান পালন করা। আল্লাহ সকলকে নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। (আমিন)
ব্লগারের জিহাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন;
comment url