তামাদি আইন ধারা ৭ ও ৮ বিশ্লেষণ —বিস্তারিত জেনে নিন

ধারাঃ ৭। বিভিন্ন বাদী অথবা দরখাস্তকারীর মধ্যে একজনের অপারগতা 

যে ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি মোকদ্দমা বা কার্যধারা দায়ের করার অথবা ডিক্রি জারির জন্য দরখাস্ত দাখিল করার অধিকারী হয়, কিন্তু তাদের মধ্যে একজন যেকোনো ধরনের অপারগ হয় এবং তার সম্মতি ছাড়াই দায়মুক্ত করা চলে, সেক্ষেত্রে তাদের সকলের প্রতিকূলেই তামাদির মেয়াদ অতিবাহিত হতে থাকবে। 


কিন্তু যদি অপারগ ব্যক্তি ব্যতীত দায়মুক্ত করা যায় না সেক্ষেত্রে তাদের কারো প্রতিকূলে তামাদির মেয়াদ অতিবাহিত হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে একজন অন্যান্যদের ছাড়া এরূপ যোগ্যতা অর্জন করে অথবা এরূপ অপারগতার অবসান হয়।

বিশ্লেষণঃ ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ৭ ধারা একক ভাবে পরিপূর্ণ করা যায় না। ৭ ধারা ও ৬ ধারা একত্রে পড়তে হবে। ৬ ধারা যে বিধান করেছে তা ৭ ধারার বিধানের অধীন। তামাদি আইনের ৭ ধারার দুটি অংশ রয়েছে — প্রথম অংশের বিধান মতে ৬ ধারা অনুসারে আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ ব্যক্তির ক্ষেত্রে তামাদি প্রয়োগ স্থগিত থাকবে না। 

দ্বিতীয় অংশ অনুসারে আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ ব্যক্তির সাথে বিশেষ সম্পর্কের কারণে আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ নয় এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও তামাদি মেয়াদ স্থগিত থাকে। এরূপ ক্ষেত্রে তামাদি মেয়াদ অতিবাহিত হওয়া শুরু হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের মধ্যে একজন অন্যান্যদের ছাড়া এরূপ যোগ্যতা অর্জন করে বা এরূপ অপারগতার অবসান হয়। 

তামাদি আইনের ৬ ধারা মতে, তামাদি মেয়াদ গননা করার সময়ে বাদী বা দরখাস্তকারী যদি আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ হয় তাহলে তার এরূপ অক্ষমতার অবসান না হওয়া পর্যন্ত তামাদি প্রয়োগ স্থগিত থাকবে। 

কিন্তু যেক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি মোকদ্দমা বা কার্যধারার দায়ের করার অথবা ডিক্রি জারির জন্য দরখাস্ত দাখিল করার অধিকারী এবং এর মধ্যে একজন এরূপ যে কোন ধরনের অপারগ হয় এবং তার সম্মতি ছাড়াই দায়মুক্ত করা চলে, সেক্ষেত্রে তাদের সকলের প্রতিকূলেই তামাদির মেয়াদ অতিবাহিত হতে থাকবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে তামাদি মেয়াদ স্থগিত থাকবে না। এটাই ৭ ধারার প্রথম অংশের বিধান।

৭ ধারার দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, যে ক্ষেত্রে আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া দায়মুক্ত করা যায় না সে ক্ষেত্রে তাদের কারো প্রতিকূলে তামাদির মেয়াদ অতিবাহিত হবে না, স্থগিত থাকবে।

উদাহরণঃ
  • ক একটি ফার্মের নিকট দেনাগ্রস্থ হয়, যে ফার্মের খ, গ এবং ঘ অংশীদার। খ পাগল এবং গ নাবালক। খ এবং গ এর সম্মতি ছাড়াই ঘ দেনাদার ক-কে দায়মুক্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে খ, গ এবং ঘ-এর প্রতিকূলে তামাদি মেয়াদ অতিবাহিত হবে।
  • ক একটি ফার্মের নিকট দেনাগ্রস্থ হয়, যে ফার্মের খ, গ এবং চ অংশীদার। খ ও গ পাগল এবং চ নাবালক। খ অথবা গ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কিংবা চ সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তাদের কারোও প্রতিকূলে তামাদি মেয়াদ অতিবাহিত হবে না।
তামাদি আইনের ৭ ধারার উপাদানঃ

তামাদি আইনের ৭ ধারার উপাদান সমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো —
  1. একাধিক ব্যক্তির মোকদ্দমা বা কার্যধারা দায়ের করার অথবা ডিক্রি জারির জন্য দরখাস্ত দাখিল করার অধিকারী হবে।
  2. একাধিক ব্যক্তির মধ্যে একজন ৬ ধারা অনুসারে যেকোনো ধরনের আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ হবে।
  3. আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া দায়মুক্ত করা চলে, বা
  4. আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারক ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া দায়মুক্ত করা চলে না।
  5. আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারক ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া দায়মুক্ত করা গেলে তাদের সকলের প্রতিকূলে তামাদি মেয়াদ অতিবাহিত হতে থাকবে, স্থগিত হবে না।
  6. আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ ব্যক্তির সম্মতি ছাড়াই দায়মুক্ত করা না গেলে তাদের কারো প্রতিকূলে তামাদির মেয়াদ অতিবাহিত হবে না, স্থগিত থাকবে।
  7. তাদের মধ্যে একজন অন্যান্যদের ছাড়া দায়মুক্ত করার যোগ্যতা অর্জন করলে তামাদি মেয়াদ পুনরায় চলতে শুরু করবে, বা
  8. আইনগত অক্ষমতা বা অপারগতার অবসান হলে তা তামাদির মেয়াদ পুনরায় চলতে থাকবে।
যে সকল ক্ষেত্রে ৭ ধারা প্রয়োগ যোগ্য হতে পারেঃ

নিচে উল্লেখিত বিষয়ের ক্ষেত্রে তামাদি আইনের ৭ ধারা প্রয়োগ যোগ্য —
  1. অংশীদারি কারবারের ক্ষেত্রে : অংশীদারি কারবারে একাধিক অংশীদার থাকে। এমন অনেক অংশীদারি কারবার আছে যেখানে একজন অংশীদার অন্যান্য অংশীদারদের সমভাবে অংশগ্রহণ ছাড়া কোন বিষয় আইনগতভাবে নিষ্পত্তি করতে পারে না বা সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা।
  2. সহ-ট্রাস্টির ক্ষেত্রে : কয়েকজন সহ-ট্রাস্টি এর মধ্যে একজন নাবালক হওয়ার জন্য আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ। যেক্ষেত্রে অন্যান্য সহ -ট্রাস্টি তার সম্মতি ছাড়া দায়মুক্ত করতে পারে। সেক্ষেত্রে যদি সাবালক সহ-ট্রাস্টি ট্রাস্ট সম্পত্তি রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে তাদের সকলের ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার তামাদিতে বারিত হবে। সহ-ট্রাস্টিগণের কেউ আর মামলা বা আবেদন করতে পারবেনা।
  3. সহ-বন্ধক দাতা বা সহ-রেহেন দাতার ক্ষেত্রে : রেহেন বা বন্ধক মুক্ত করার অধিকার অবিভাজ্য। এজন্য সহ-বন্ধক দাতা বা সহ-রেহেন দাতার ক্ষেত্রে আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া বন্ধক বা রেহেন মুক্ত করা যায় না। এজন্য তাদের কারো প্রতিকূলে তামাদি মেয়াদ অতিবাহিত হবে না, স্থগিত থাকবে।
  4. যৌথ উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে : হিন্দু বা মুসলিম যে সম্প্রদায়ের হোক না কেন, কোন উত্তরাধিকারী বাকি উত্তরাধিকারীদের সম-অংশগ্রহণ ছাড়া পূর্বপুরুষের কোন দেনা বা ঋণ পরিশোধ করলে তা বৈধ হবে না। আর এই কারণেই তাদের কারো প্রতিকূলে তামাদির মেয়াদ অতিবাহিত হবে না, স্থগিত থাকবে।

ধারাঃ ৮। বিশেষ ব্যতিক্রম —

৬ অথবা ৭ ধারার কোন কিছু অগ্রক্রয়ের অধিকার এর মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বা যে মেয়াদের মধ্যে মামলা অবশ্যই দায়ের বা দরখাস্ত করতে হবে, সে ব্যক্তির অপারগতার অবসানের বা মৃত্যুর পর তা ঐ ধারাদ্বয়ের কোন কিছুই তিন বছরের বেশি হবে না।

প্রতারণা করা না হলে, এটা শুধু মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

মামলা : 24 Madras 387.

বিশ্লেষণঃ তামাদি আইনের ৮ ধারা, ৬ ও ৭ ধারা অনুসারে অক্ষমতা বা অপারগতার জন্য তামাদি স্থগিত হলেও তামাদির পরিমাণকে সীমিত করে তিন বছর করা হয়েছে। ৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির অপারগতার অবসানের বা মৃত্যুর পর তা এই ৬ ও ৭ ধারার কোন কিছুই তিন বছরের বেশি বর্ধিত করেছে বলে গণ্য হবে না। এছাড়াও বলা হয়েছে যে, ৬ বা ৭ ধারার কোন কিছুই অগ্রক্রয়ের অধিকার বলবতের মামলায় প্রযোজ্য নয়।

অতিরিক্ত তিন বছরের বেশি তামাদির মেয়াদ বর্ধিত হবে নাঃ

তামাদি মেয়াদ গননা করার সময়ে বাদী বা দরখাস্তকারী যদি আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ হয়, অর্থাৎ নাবালক, পাগল বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বা জড়বুদ্ধি সম্পন্ন হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে তামাদি মেয়াদ চলতে পারে না। তাদের এই রোগ অক্ষমতার অবসান না হওয়া পর্যন্ত তামাদি মেয়াদ স্থগিত থাকবে। ৮ ধারা অনুসারে নালিশের কারণ সৃষ্টি হতে নির্ধারিত তামাদি মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পর তিন বছরের অধিক অতিরিক্ত সময় প্রদান করবে না। (5 DLR 383) ।

উদাহরণঃ

(ক) ক নাবালক থাকাকালে উইল মূলে প্রাপ্ত সম্পত্তি আদায়ের জন্য মোকদ্দমা করার অধিকার লাভ করে এবং এর ১১ বছর পর সে সাবালক হয়। ক সাধারণত আইন অনুসারে মোকদ্দমা দায়েরের জন্য মাত্র অবশিষ্ট এক বছর সময় পাই। কিন্তু ৬ ধারা এবং এই ৮ ধারা অনুসারে সে আরও দুই বছর বর্ধিত সময় পাবে। অর্থাৎ ক সর্বসাকুল্যে সাবালক হওয়ার পর তিন বছর সময় পাবে, যার মধ্যে সে মামলা দায়ের করতে পারবে।

(খ) ক পাগল থাকাকালে বংশগত একটি পদ লাভের জন্য মোকদ্দমা করার অধিকারী হয়। এর ৬ বছর পর ক সুস্থ হয়। সাধারণ আইন অনুসারে ক সুস্থ হওয়ার পর ৬ বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে পারে। ৬ ধারা ও এই ধারা অনুসারে ক- এর মোকদ্দমা দায়ের করার মেয়াদ আর বর্ধিত হবে না।

প্রথম তফসিল অনুসারে তামাদি মেয়াদ যদি তিন বছরের কম হয় তাহলে তিন বছরের কম যে মেয়াদ প্রথম তফসিলে উল্লেখ থাকবে মামলা বা দরখাস্ত করার জন্য তামাদির সেই মেয়াদ লাভ করবে। এক্ষেত্রে তিন বছরের কম নির্ধারিত তামাদি মেয়াদ লাভ করবে। কোনভাবে অতিরিক্ত বা তিন বছরের বেশি সময় লাভ করবে না।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, তামাদি আইনের প্রথম তফসিলের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে আইনগত প্রতিনিধি মোকদ্দমা আইন, ১৮৫৫-এর আওতায় নির্বাহকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার তামাদি মেয়াদ ২ বছর। নির্বাহকের বিরুদ্ধে মামলার কারণ উদ্ভব হওয়ার আগে বাদী বা দরখাস্তকারী আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ হওয়ার জন্য তামাদি স্থগিত থাকে। 

এরূপ অক্ষমতা বা অপারগতার অবসানের পর তামাদি মেয়াদ পুনরায় শুরু হয়। বাদী বা দরখাস্তকারী যতদিনই আইনগতভাবে অক্ষম বা অপারগ থাকুক না কেন সুস্থ হওয়ার পর মামলা করার জন্য দুই বছর সময় পাবে। 

সুতরাং বলা যায় যে, প্রথম তফসিল অনুসারে তামাদি মেয়াদ যদি তিন বছরের বেশি থাকে তাহলে ৮ ধারা অনুসারে তামাদির সময় কমে যায়। কিন্তু যদি তিন বছরের কম থাকে তাহলে ৮ ধারা অনুসারে তামাদির সময় কমে যায় না।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগারের জিহাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন;

comment url