হযরত রাবিয়া বসরী (রহ)

যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন ব্যক্তি যারা মহান আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। তারা নবী রাসুলগণের অনুসরণে মানুষকে সত্য পথে সন্ধান দিতেন। এমনই একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন হযরত রাবিয়া বসরী (রহ)।

জন্ম ও পরিচয়

হযরত রাবেয়া বসরি (রহ) ৯৯ হিজরী মোতাবেক ৭১৭ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাই তাকে বসরি বলা হয়। তার পিতার নাম ইসমাইল এবং মাতার নাম মায়ফুল। তারপর পিতা খুব দরিদ্র ছিলেন। যেদিন রাতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ঐদিন রাতে তার পিতার ঘরে প্রদীপ জ্বালানোর মতো তেল ছিল না। 

চার বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ ছিলেন। তাই তার নাম রাখা হলো রাবিয়া (অর্থ চতুর্থ)।শৈশবে তার পিতামাতা ইন্তেকাল করেন। হলে তাকে অতি কষ্টের দিন পার করতে হতো।

শিক্ষাজীবন

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ) খুব অল্প বয়সেই মা-বাবার কাছ থেকে কোরআন, হাদিস, ফিকহ্শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেন। শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে তার কখনো কোনো সংকোচ ছিল না। তিনি দরিদ্র হলেও পরম ধার্মিক ও আল্লাহ ভক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন ভদ্র, নম্র ও সংযমী। সেই সঙ্গে প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ও ছিলেন তিনি। 

সব সময় গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন হয়েছে যেতেন। রাগ, হিংসা ও অহংকার তার চরিত্রকে কখনো কলুষিত করতে পারেনি। মোটকথা আল্লাহর একজন প্রকৃত অলি হওয়ার জন্য যে গুণাবলী থাকা প্রয়োজন এর সবকিছুই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। দীর্ঘ সাধনার পর রাবেয়া বসরী (রহ) ইলমে তাসাউফ ও মারেফাতের তীক্ষ্ণ জ্ঞান অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে রাবেয়া একজন কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

ক্রীতদাসীর জীবন

হযরত রাবেয়া বসরী (রহ) এর মাতা পিতা ইন্তেকালের পর তার বড় বোনের জীবন ও জীবিকা অন্বেষণে অন্যত্র চলে যাই। নিঃসঙ্গ রাবিয়া বসরী (রহ) কান্নাকাটি করে কাটাতে লাগলেন দিনের পর দিন। হঠাৎ এক পাণ্ডব এসে জোর করে তুলে নিয়ে গেল রাবিয়া বসরি কে। দাসী কেনাবেচার হাতে নিয়ে তাকে বিক্রি করে দিল পাষাণ হৃদয় এক ব্যক্তির নিকট। 

ক্রীতদাস্তে পরিণত হলেন রাবিয়া বসরি। তিনি দিনের বেলায় কঠোর পরিশ্রম করতেন। রাতের বেলায় জাগ্রত থেকে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করতেন। হঠাৎ এক মাঝরাতে তার মনিবের ঘুম ভেঙে যায়। মনিব অস্পষ্ট কিছু কথায় গুঞ্জন শুনতে পায়। গভীর অন্ধকারে কার কথার শব্দ? খুঁজতে যেতে দেখতে পান রাবেয়া বসরি ইবাদত করছে। 

অকূল ঝরে প্রার্থনা করছে প্রভুর দরবারে। একপর্যায়ে রাবিয়া মোনাজাত ধরে আল্লাহ তায়ালার দরবারে বললেন, হে আল্লাহ তুমি আমাকে কোন মানুষের অধীন করে না রাখলে আমি সর্বক্ষণ শুধু তোমার ইবাদত করতাম। রাবিয়ার অকুল প্রার্থনা শুনে মনিবের মন গলে যাই। মনিব মনে মনে বলল হাই এ আমি কাকে আমার ঘরের দাসী বানিয়ে রেখেছি? সে তো সামান্য নারী হতে পারে না। 

সে নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রিয়জন। এ ঘটনার পরদিন সকালে মনে রাবিয়া বসরিকে দাসত্ব জীবন থেকে মুক্ত করলেন। এবার রাবিয়া বসরী মুক্ত হয়ে নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করলেন প্রভুর ইবাদতে। জীবনে বিয়ে করেননি। কেবল আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে কাটিয়ে দিয়েছেন।

আল্লাহর উপর আস্থা ও ইবাদত

তাফসি রাবেয়া বসরি (রহ) আল্লাহর ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি জির্ণ কোটিরে বসবাস করতেন। তবু কোন মানুষের সাহায্য গ্রহণ করতেন না। একবার হরযত রাবিয়া বসরি (রহ) অসুস্থ হলে আব্দুল ওয়ালিদ ওমর ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিস সুফিয়ান সাউরি তাকে দেখতে যান। 

তখন সুফিয়ান শাউড়ি হযরত রাবিয়া বসরী (রহ) কে বললেন, যদি আপনি দোয়া করেন তাহলে আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করে দেবেন। রাবেয়া বসরী (রহ) বললেন, হে আবু সুফিয়ান হে আবু সুফিয়ান আপনি কি জানেন না কার ইচ্ছায় আমার এই অসুস্থতা? যার ইচ্ছা তিনি কি আল্লাহতালা নন? সুফিয়ান বলেছেন, হ্যাঁ রাবেয়া বসরী (রহ) বললেন, তাহলে কেন আমাকে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রার্থনা করতে বলছেন।

মালিক ইবনে দিনার একজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি রাবিয়া বসরি (রহ) এর পরিচিত ছিলেন। তিনি একদা রাবেয়ার আর্থিক দুরবস্থা দেখে বললেন, আপনি বললে আমি আমার এক ধনী বন্ধু থেকে আপনার জন্য সাহায্য আনতে পারি। 

রাবিয়া বললেন, হে মালিক আমাকে এবং আপনার বন্ধুকে আল্লাহ রিজিক দেন না? মালিক বলল হ্যাঁ, রাবেয়া আবার বলল, আল্লাহ কি দরিদ্রকে তার দারিদ্র্যের কারণে ভুলে যাবেন এবং ধনীদের তাদের সম্পদের কারণে মনে রাখবেন? মালিক বলল না। 

তখন রাবিয়া বললেন, আল্লাহ যেহেতু আমার অবস্থা জানেন, তখন তাকে আমার আবার স্মরণ করানো দরকার কি? বিশিষ্ট আরবি সাহিত্যিক আল জাহিয বললেন, রাবেয়ার কয়েকজন পরিচিত লোক তাকে বললেন, আমরা যদি আপনার আত্মীয়স্বজনদের বলি তাহলে তারা আপনাকে একজন ক্রীতদাস কিনে দেবেন। 

রাবিয়া বললেন, সত্য কথা এই যে যিনি সমস্ত পৃথিবীর মালিক তার কাছে পার্থিব কিছু চাইতে আমার লজ্জা হয়। অতএব যারা পৃথিবীর মালিক নয় তাদের কাছে কি করে আমি চাইতে পারি?

ইবাদাত করার ক্ষেত্রে হযরত রাবেয়া বসবি (রহ) ছিলেন অতুলনীয়। তিনি যখনই সময় পেতেন তখনই আল্লাহতালার ইবাদাতে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। অধিকাংশ সময় তিনি দিনের রোজা রাখতেন আর রাতে নফল সালাত আদায় করতেন। তিনি সর্বদা আল্লাহতালার নিকট এ প্রার্থনা করতেন যে, হে প্রভু আমাকে আমার নিজ কাজে ইবাদত ব্যস্ত রাখুন যাতেক আমাকে কেউ আপনার রিজিক হতে বিমুখ করতে না পারে।

আধ্যাত্মিকতা

শুধু পুরুষরাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছেন এমন নয়। অনেক নারী ও আল্লাহর অলি হয়েছে। আল্লাহ তাদের অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দিয়েছেন। হযরত রাবিয়া বসরী (রহ) এরা অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। একবার হযরত রাবেয়া বসরি (রহ)খাবার রান্না করতে গেছেন।দেখেন পেঁয়াজ নেই। ভাবছেন, পেঁয়াজ কোথা থেকে আনবো কিভাবে আনবো কোন দাসদাসী নেই। 

সেবক সেবিকা ও নেই। মনে মনে একথাই ভাবছিলেন। এমন সময় লক্ষ্য করলেন, একটি চিল উড়ে যাচ্ছে। তার পায়ে পেঁয়াজ। শিল্পী আজ গুলো ছুড়ে মারল আর তা সোজা হরযত রাবেয়ার কাছে এসে পড়ল। তাকে বলা হলো রাবিয়া তুমি আমার হয়ে গেছো আমি চিলকে তোমার সেবায় নিয়োজিত করলাম।

হযরত রাবিয়া বসরী (রহ) একবার শস্য বুনছিলেন।পঙ্গপাল শস্য ক্ষেতের ওপর এসে পড়েছিল। তখন রাবেয়া প্রার্থনা করে বললেন হে আমার প্রভু এ হলো আমার জীবিকা। যদি আপনি চান তাহলে আমি তা আপনার শত্রুদের বা বন্ধুদের দিয়ে দেব। তখন পঙ্গপাল পুড়ে গেল।

আল্লাহর অলিদের বহু অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। তবে তারা এসব ক্ষমতা নিয়ে কখনো অহংকার করেননি। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো তা প্রকাশ করেননি, বরং তা আপনা আপনি প্রকাশিত হয়ে যেত।

অনাড়ম্বর জীবনযাপন

হযরত রাবেয়া বসরি (রহ)সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। তিনি সর্বদা নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে করতেন। আল্লাহর নিকট বেশি বেশি ক্ষমা চাইতেন সর্বদা আন্তরিকভাবে আল্লাহর নিকট তওবা করতেন। তিনি বলতেন মুখে মিথ্যা তওবা করে কি লাভ যদি তা প্রমাণ না করা যায়? তিনি সর্বদা মহান আল্লাহর গুণন কীর্তন ও মানব সেবায় রত ছিলেন।

রাবিয়া বসরি (রহ)এর ইন্তেকাল

অনেক শ্রম, কষ্টসাধ্য ও আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ জীবনযাপন করার পর আল্লাহর প্রিয় এ নারী ১৮৫ হিজরী মোতাবেক ৮০১ খ্রিস্টাব্দে বছরে ইন্তেকাল করেন। তাকে বসরায় দাফন করা হয়।

বর্ণিত আছে যে মোহাম্মদ ইবনে তুসি নামক এক লোক তার কবরে যান। গিয়ে বললেন যে, হে রাবেয়া আপনি গর্ব করতেন যে উভয় জগতের বিনিময়েও আপনি আপনার মাথা নত করবেন না। আপনি কি সেই উন্নত অবস্থা লাভ করেছেন? জবাব একটি আওয়াজ এল, আমি যা চেয়েছিলাম তা আমি পেয়েছি। আমরা তার জীবনের আলোকে আমাদের জীবন গড়বো। ইহকাল ও পরকালের শান্তি প্রাব।

লেখকের মন্তব্য

আশা করি পোস্ট টি থেকে আপনি অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছেন। পোস্ট টি হতে কোনো উপকার পেলে বা পোস্ট টি ভালো লাগলে পরিচিত দের সাথে সেয়ার করুন। আর আপনার কোনো সমস্যা বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না। আর এমন পোস্ট পেতে অবশ্যই আমাদের গুগলে ফোলো করে রাখুন। 

কেননা আমরা প্রতিনিয়ত এমন পোস্ট করে থাকি। যা আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি তে ভূমিকা রাখবে। আমরা আমাদের জন্য নির্ভুল তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের আর্টিকেলে যদি কোন প্রকার ভুল থাকে তবে তা কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। এর ফলে আমরা পরবর্তীতে সে ভুল সংশোধন করতে পারবো এবং আপনাদের নির্ভুল ও সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারবো।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগারের জিহাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন;

comment url