ইমাম হাসান (রাঃ)

হযরত হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হলেন মহানবী সাঃ এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র। তিনি আহলুল বাইট বা নবী পরিবারের অন্যতম সদস্য ছিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। চার খলিফার পরে তিনি ছিলেন সর্বশেষ খলিফা।

জন্ম ও শৈশব

হযরত ফাতেমা তুজ জাহরা রাজাল্লাহু তা'আলা আনহু ও হযরত আলী (রাঃ) এর ঘরে আলোকিত করে তৃতীয় হিজরী মোতাবেক ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে রমজান মাসে হযরত হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর জন্ম গ্রহণ করেন। তার জন্মে মহানবী (সাঃ) অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। আলী (রাঃ) এর কাছে এসে তিনি বললেন, আমার নাতিকে দেখাও।

তার নাম কি রেখেছো? আলী (রাঃ) প্রথমে নাম রেখেছিলেন, হারব। মহানবী (সাঃ) তার হার হারব নাম বদলে নাম রাখেন হাসান। তিনি নিজে হাসান রাজালানহু এর কানে আযান দেন এবং মেস দিয়ে আকিকা করেন।

হযরত হাসান (রাঃ) এর শৈশব রাসুল (সাঃ) এর পরম স্নেহ ও ও ভালোবাসায় অতিবাহিত হয়েছে। কখনো কখনো রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সিজদা দেওয়ার সময় তিনি ও তার ছোট ভাই হোসাইন রা: এসে পিঠে চড়ে বসতেন। তারা যেন বেশিক্ষণ পিঠে থাকতে পারেন, সেজন্য তিনি নামাজের সিজদা ও দীর্ঘায়িত করতেন।

রাসূলুল্লাহ (সা:) তাকে কখনো কখনো কোলে নিয়ে হাঁটতেন। হাসান হোসেন দুই ভাই তার কাছে দৌড়ে এলে তিনি তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতেন। একবার তারা দুজনে লাল রঙের জামা পড়ে বের হলেন। কিন্তু তারা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। মহানবী (সা:) তখন খুতবা দিয়েছিলেন। তিনি খুতবা বন্ধ রেখে দ্রুত নেমে এসে তাদেরকে উঠিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন।

আরেকবার মনে সাল্লাহু সালাম হযরত হাসান (রাঃ) কে কাঁধে উঠালেন। তখন একজন সাহাবী বললেন, হে বালক তুমি কত উত্তম সওয়ারিতে আহরণ করছ। এ কথা শুনে মহানবী (সা:) বললেন আহরি নিজেও তো কত উত্তম। হযরত হাসান (রাঃ) এর বয়স যখন সাত বছর, তখন রাসুলুল্লাহ সাঃ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

শিক্ষা-দিক্ষা

হযরত হাসান (রা:) নানা হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর পিতা আলী (রাঃ) মা খাতুনে জান্নাত হাতিমা রা: প্রমুখের কাছে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি তার থেকে সালাতুল বেশকিছু দোহাইসহ বেশি কিছু হাদিস বর্ণনা করেছেন। একবার হাসান রা: সদ্যকা হিসেবে দেওয়া একটি খেজুর মুখে দিলেন। 

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজেই সেই খেজুর তার মুখে বের করে আনেন এবং তাকে বুঝিয়ে দেন, নবী পরিবারের জন্য মানুষের দান সদকা গ্রহণ করা বৈধ নয়। এভাবে মহানবী (সাঃ) নিজেই তাকে তালিম তরবিয়ত শিক্ষা দেন।

হযরত হাসান (রাঃ) এর সম্মান ও মর্যাদা

অসংখ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হযরত হাসান রা: এর মর্যাদা স্পষ্ট করেছেন। হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, হযরত হাসান এবং হোসাইন (রা:) জান্নাতের যুবকদের সরদার হবেন। তারা দুনিয়াতে মহানবী (সা:) এর দুটি ফুল স্বরূপ। হযরত হাসান (রাঃ) এর জন্য তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন,

আল্লাহ আমি হাসানকে ভালোবাসি। আপনিও হাসানকে ভালবাসুন। আরজে হাসানকে ভালোবাসে তাকেও আপনি ভালবাসুন।

তাই হাসান (রা:) কে ভালোবাসা আল্লাহ তাআলার ভালবাসার প্রাপ্তিরঅন্যতম উপায়।

বিশিষ্ট সাহাবীগণ ও ইমাম হাসান (রাঃ) কে সম্মান ও মর্যাদা দৃষ্টিতে দেখতেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) তার সওয়ারির রেকাব ঠিক করে দিতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়র রা: তার কাছে বসলে অত্যন্ত শীতের রাতেও ঘেমে উঠতেন। বলতেন তিনি ফাতেমার সন্তান।

খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে তারপরে খিলাফত চলবে ত্রিশ বছর। তারপরে ইমাম হাসান (রা:) খলিফা হিসেবে ৪০ হিজরির রমজান মাসে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রায় ছয় মাস খিলাফতের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। এরপর মুসলিম ওমরাহর ঐক্য রক্ষার সাথে আমি রে মুয়াবিয়া (রা:) এর সঙ্গে সন্ধি করেন এবং ক্ষমতা তার হাতে নিয়ে ন্যস্ত করেন। 

আসলে এটি ছিল মহানবী (সাঃ) এর একটি ভবিষ্যৎ বাণীর বাস্তবায়ন। তিনি হাসান (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আমারও দৌহিত্র সর্দার হবে আর সম্ভবত আল্লাহ তা'আলা তার মাধ্যমে মুসলিমদের দুটি দলের মাঝে মীমাংসা করে দেবেন।

চরিত্র ও দেহসৌষ্ঠব

ইমাম হাসান (রা:) এর চেহারা ও শরীরের গঠন মহানবী (সাঃ) এর পবিত্র শরীরের অঙ্গের সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। একবার হযরত হাসান (রা:) শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করছিলেন। আবু বকর (রা:) তাকে দেখে কাঁধে তুলে নিলেন। বললেন আরে হাসান তো দেখতে মহানবী (সাঃ) এর মত আলীর মত নয়। 

আলী (রা:) এ কথা শুনে হেসে ফেললেন। আনাস (রা:) বলেছেন বলেছেন হযরত হাসান রাসূলুল্লাহ (সা:) এর সঙ্গে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ ছিলেন ।

হযরত হাসান (রাঃ) অনেক বেশি ইবাদত বরন্দেগি ছিলেন। ফজরের নামাজ পড়ার পর তিনি সব সময় সূর্যদয়েই পর্যন্ত নামাজের স্থানে বসে থাকতেন এবং জিকর আজকার করতেন। তিনি মোট ১৫ বার পায়ে হেঁটে হজ করেছিলেন, কোন বাহন ব্যবহার করেননি। তিনি একটি কবিতায় বলেছেন,

يا شعب يعاني من العالم. العالم ليس دائمًا، ومن الحماقة بالتأكيد أن يربكك الظل المتلاشي

অর্থ: ওহে দুনিয়ার ভোগী মানুষ। দুনিয়া দশ্থায়ী নয়, অপসৃয়মান ছায়া বিভ্রান্ত হওয়া তো নিশ্চয়ং নির্বুদ্বিতা।

জীবনেীকারোগণ তার মহান চরিত্রের বহু দিকে উল্লেখ্য করেছেন। যেমন তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, দানশীল, ধৈর্যশীল, গভীর প্রজ্ঞাবান এবং দুনিয়া বি মুখো ব্যক্তি ছিলেন। তার আচরণে সবাই মুগ্ধ হতো। সর্বসাধারণ তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতে। 

একবার হরযত হাসান (রাঃ) একটি লোককে দোয়া করতে শুনলেন। সে আল্লাহর দশ হাজার দিরহাম প্রার্থনা করেছিল। হাসান (রা:) তখনই বাসায় এসে ওই লোকটিকে দশ হাত দিরহাম দিয়ে দিলেন। আরেকবার তিনি একটি বাগানে গিয়ে দেখতে পেলেন, একজন দাস রুটি খাচ্ছেন এবং নিজের রুটি থেকে একটি কুকুরকেও খেতে দিচ্ছে। 

তিনি বললেন তুমি কুকুরটিকে খাওয়াচ্ছ? দাস বলল, ওকে রেখে আমার একা এতে সংকোচ হচ্ছে। তখনই হাসান (রা:) বললেন তুমি এখানেই থাকো। আমি না আসা পর্যন্ত যেও না। এরপর তিনি ওই বাগানের মালিকের কাছে গিয়ে ওই বাগান এবং দাসকে কিনে নিলেন। এরপর ফিরে এসে দাসকে মুক্ত করে দিয়ে বাগানটিও তাকে দান করলেন। সেই দাস অভিভূত হয়ে তখনই বাগানটিকে আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিলেন।

আর একবার হযরত হাসান ইবনে আলী (রা:) একটি খচ্চরে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। প্রতিমধ্য একদল দারিদ্র মানুষের সঙ্গে দেখা হলো। তারা মাটিতে খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাচ্ছিল আর লোকদের কাছে ভিক্ষা করছিল। হযরত হাসানকে দেখে তারা বলল, হে রাসূলুল্লাহর সন্তান, আসুন আমাদের সঙ্গে নাস্তা করুন।

হাসান (রাঃ) তখনই বাহন থেকে নেমে পড়লেন এবং মাটিতে বসে তাদের সঙ্গে মাটিতে ছড়ানো খাবার খেলেন। এরপর বললেন, তোমাদের দাওয়াত কবুল করেছি। এবার আমার দাওয়াত কবুল করতে হবে। এরপর একটি সময় তাদের সবাইকে তিনি ডাকলেন এবং অনেক মূল্যবান খাবারের ব্যবস্থা করলেন। এবারও তিনি তাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেলেন।

ইন্তেকাল

হাসান (রাঃ) কে একদল অজ্ঞাতনামা দুষ্টু তো কারে বিষ খাইয়েছিলেন। এই বিষক্রিয়ার প্রভাবে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মদিনা মুনাওয়ারাই শাহাদাত বরণ করেন। 

সেদিন মসজিদে নববীতে আবু হুরায়রা অবস্থায় চিৎকার করে সমবেত জনতাকে বললেন,ওহে মানুষ নবীজি (সাঃ) প্রিয়তম ব্যক্তি আজ ইন্তেকাল করেছে। তোমরা কাঁদো, জানাযার শেষে হযরত হাসান (রাঃ) কে জান্নাতুল বাকিতে তার মা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর কবরের পাশে দাফন করা হয়।

লেখকের মন্তব্য

আশা করি পোস্ট টি থেকে আপনি অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছেন। পোস্ট টি হতে কোনো উপকার পেলে বা পোস্ট টি ভালো লাগলে পরিচিত দের সাথে সেয়ার করুন। আর আপনার কোনো সমস্যা বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না। আর এমন পোস্ট পেতে অবশ্যই আমাদের গুগলে ফোলো করে রাখুন। 

কেননা আমরা প্রতিনিয়ত এমন পোস্ট করে থাকি। যা আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি তে ভূমিকা রাখবে। আমরা আমাদের জন্য নির্ভুল তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের আর্টিকেলে যদি কোন প্রকার ভুল থাকে তবে তা কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। এর ফলে আমরা পরবর্তীতে সে ভুল সংশোধন করতে পারবো এবং আপনাদের নির্ভুল ও সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারবো।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগারের জিহাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন;

comment url