কোরআন হাদিসের আলোকে মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন
মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য
মা-বাবা হচ্ছে আল্লাহ পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত। পার্থিব জীবনে মা-বাবার চেয়ে আপন কেউ নেই। আর পিতামাতা এমন দুইজন ব্যক্তি যারা সন্তানের কখনো খারাপ চায় না। তারা সব সময় চায় তাদের সন্তান সুখে শান্তিতে থাকুক। আর আল্লাহ তাআলা মা-বাবা কে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।
সুতরাং এ বেহেস্ত অর্জন করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে মা। তবে আল্লাহ তা'আলা মায়ের সাথে বাবার মর্যাদাও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে হলে তাদের সাথে সব সময় ভালো ব্যবহার করতে হবে। তাদের যথাযথ সম্মান করতে হবে , তাদের যত্ন নিতে হবে এবং তাদের সাথে ভালোভাবে কথা বলতে হবে।
কোরআন ও হাদিসের আলোকে মা-বাবার প্রতি সন্তানের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো হলো-
- পিতা-মাতার সঙ্গে সর্বাবস্থায় সদ্ব্যবহার করা এবং তাদের প্রতি যথাযথ অনুগ্রহ প্রদর্শন করা।
- সব সময় সুন্দর ও মার্জিত ভাষায় কথা বলা।
- তাদের সুখ-শান্তির জন্য নিজেদের ধনসম্পদ হতে ব্যয় করা ও তাদেরকে বোঝা মনে না করা।
- তাদের সঙ্গে নম্রভাবে ও সালীনতার সাথে চলাফেরা করা।
- যে কোনো বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা ।
- তাদের সঙ্গে কর্কশ ভাবে ও রুক্ষ ভাষায় কথা না বলা।
- তাদের যথাযথভাবে সম্মান প্রদর্শন করা ও তাদের প্রতি বিরক্তি ভাব প্রকাশ না করা।
- পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের জন্য আল্লাহতায়ার কাছে মাগফিরাতের দোয়া করা।
- তাদের ঋণ পরিশোধ করা ও তাদের ওসিয়তগুলো পূর্ণ করা।
কোরআনে বর্ণিত মাতা পিতার প্রতি সন্তানদের কর্তব্য
আল্লাহ তাআলা আল কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার আদেশ করেছেন। আমাদের জীবনে তাদের কতটুক অবদান সেটি মনে করিয়ে দিয়েছেন। আর তারা আমাদের শৈশবকালের যেভাবে আমাদের উপর যেভাবে অনুগ্রহ করেছেন তাদের উপর আমাদেরকেও একই ভাবে অনুগ্রহ করার নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَ اعۡبُدُوا اللّٰهَ وَ لَا تُشۡرِكُوۡا بِهٖ شَیۡئًا وَّ بِالۡوَالِدَیۡنِ
অর্থ: তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে শরিক করো না এবং পিতা–মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৩৬)।
এখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন তার ইবাদত করতে এবং তার সাথে শরিক করতে নিষেধ করেছেন আর আদেশ করেছেন পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে। অর্থাৎ পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সমস্ত নেয়ামত ও অনুগ্রহ একান্তই আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে, কিন্তু বাহ্যিক ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহর পরে মানুষের প্রতি সর্বাধিক ইহসান বা অনুগ্রহ থাকে পিতা-মাতার।
পিতা-মাতাই সন্তানকে জন্ম দেন এবং তার শিশু অবস্থা থেকে তার যৌবন বয়স পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাকে বড় করেন। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি গুরুত্বারোপ করে তার ইবাদতের পর পরই পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে বলেছেন।
আল কোরআনে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন,
وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡهِ اِحۡسٰنًا ؕ حَمَلَتۡهُ اُمُّهٗ كُرۡهًا وَّ وَضَعَتۡهُ كُرۡهًا ؕ وَ حَمۡلُهٗ وَ فِصٰلُهٗ ثَلٰثُوۡنَ شَهۡرًا
অর্থ: আর আমি নির্দেশ দিয়েছি মানুষকে, তার পিতা–মাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার। তার মা তাকে বহন করেছে কষ্টের সাথে, আর তাকে প্রসব করেছে কষ্টের সাথে। তাকে গর্ভে ধারণ ও দুধপান ছাড়ানোয় সময় লাগে ত্রিশ মাস। (সুরা আহকাফ, আয়াত: ১৫)।
তিনি আরও বলেন,
وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡهِ ۚ حَمَلَتۡهُ اُمُّهٗ وَهۡنًا عَلٰی وَهۡنٍ وَّ فِصٰلُهٗ فِیۡ عَامَیۡنِ اَنِ اشۡكُرۡ لِیۡ وَ لِوَالِدَیۡكَ ؕ اِلَیَّ الۡمَصِیۡرُ
আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি (কেননা) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’ বছরে তুমি শোকর আদায় কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার। আমারই কাছে (তোমাদেরকে) ফিরে আসতে হবে। (সুরা লুকমান, আয়াত: ১৪)।
এখানে আল্লাহ তাআলা সন্তান ধারণের সময় মা যে কষ্ট করেছন এবং তার স্তনের দুগ্ধ পান করিয়েছেন দীর্ঘ ২ বছর যাবত তার কথা উল্লেখ্য করেছেন। আর প্রত্যেক সন্তানকে আদেশ করেছেন যে, তোমার মা তোমাকে গর্ভেধারণ করার সময় অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন এবং দীর্ঘ দুই বছর তোমাকে দুধ পালন পান করিয়েছেন। যার ঋণ কখনো শোধ করা সম্ভব নয়। যেহেতু তুমি আমারও তোমার মাতা পিতার শোকর আদায় কর।
وَ اِنۡ جَاهَدٰكَ عَلٰۤی اَنۡ تُشۡرِكَ بِیۡ مَا لَیۡسَ لَكَ بِهٖ عِلۡمٌ ۙ فَلَا تُطِعۡهُمَا وَ صَاحِبۡهُمَا فِی الدُّنۡیَا مَعۡرُوۡفًا ۫ وَّ اتَّبِعۡ سَبِیۡلَ مَنۡ اَنَابَ اِلَیَّ ۚ ثُمَّ اِلَیَّ مَرۡجِعُكُمۡ فَاُنَبِّئُكُمۡ بِمَا كُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ
তারা যদি এমন কাউকে (প্রভুত্বে) আমার সমকক্ষ সাব্যস্ত করার জন্য তোমাকে চাপ দেয়, যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে থাকবে। এমন ব্যক্তির পথ অবলম্বন করো, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে।অতঃপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করব তোমরা যা-কিছু করতে। (সূরা লোকমান, আয়াত:১৫)
অর্থাৎ দিনের ব্যাপারে মাতা পিতা কোন অন্যায় আবদার করলে তাদের অন্যায় আবদার মানা জায়েজ না। কিন্তু তারা অন্যায় আবদার করলেও তাদের কে কোন কষ্টদায়ক কথা বলা যাবে না। তাদেরকে নম্রভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে তাদের কথা শুনতে অপারগ। আর তাদের সাথে সবসময় সৎ ব্যবহার করতে হবে তাদের সেবা যত্ন করতে হবে। যদিও তারা অমুসলিম হয়। যেহেতু মাতা পিতা ভ্রান্ত পথে আছে সেও তো তাদের অনুসরণ করা যাবে না যারা সঠিক পথে আছে আল্লাহর অনুগ্রহের রাস্তায় আছে তাদেরকে অবলম্বন করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করার ও তাদের প্রতি বিরক্ত ভাব প্রকাশ না করার ব্যাপারে বলেন,
وَقَضٰى رَبُّكَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِيَّاهُ وَبِالۡوَالِدَيۡنِ اِحۡسَانًا ؕ اِمَّا يَـبۡلُغَنَّ عِنۡدَكَ الۡكِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوۡ كِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّلَا تَنۡهَرۡهُمَا وَقُلْ لَّهُمَا قَوۡلًا كَرِيۡمًا
وَاخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحۡمَةِ وَقُلْ رَّبِّ ارۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيٰنِىۡ صَغِيۡرً
অর্থ : আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল।
তাদের জন্য সদয়ভাবে নম্রতার বাহু প্রসারিত করে দাও আর বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর যেমনভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন পালন করেছেন।’ (সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ২৩ ও ২৪)
আল্লাহ তাআলা পিতা মাতার জন্য সম্পদ ব্যয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন,
یَسۡـَٔلُوۡنَكَ مَا ذَا یُنۡفِقُوۡنَ ۬ؕ قُلۡ مَاۤ اَنۡفَقۡتُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ فَلِلۡوَالِدَیۡنِ وَ الۡاَقۡرَبِیۡنَ وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰكِیۡنِ وَ ابۡنِالسَّبِیۡلِ ؕ وَ مَا تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ فَاِنَّ اللّٰهَ بِهٖ عَلِیۡمٌ
অর্থ : তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? বল, ‘তোমরা যে সম্পদ ব্যয় করবে, তা পিতা-মাতা, আত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য। আর যে কোন ভাল কাজ তোমরা কর, নিশ্চয় সে ব্যাপারে আল্লাহ সুপরিজ্ঞাত’। (সুরা বাকারা, আয়াত :২১৫)
হাদিসে এসেছে
- ১আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত। (সুনানে তিরমিজি : ১৮৯৯)
- ২একজন সাহাবি নবীজি (সা.)–কে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকার সবচেয়ে বেশি কার? নবীজি (সা.) বললেন, তোমার মায়ের। সাহাবি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, নবীজি (সা.) বললেন, তোমার মায়ের। সাহাবি আবারও জানতে চাইলেন, নবীজি (সা.) বললেন, তোমার মায়ের। এরপর সাহাবি জানতে চাইলে নবীজি (সা.) বললেন, তোমার বাবার। (বুখারি ও মুসলিম)।
- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পিতা–মাতা হলো তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম অর্থাৎ তুমি ইচ্ছা করলে তাদের খেদমত করে উত্তম আচরণের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারো; আবার ইচ্ছা করলে তাদের অবাধ্য হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করতে পারো।’ (ইবনে মাজাহ)।
- রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যখন কোনো অনুগত সন্তান স্বীয় পিতা-মাতার প্রতি অনুগ্রহের নজরে দৃষ্টিপাত করে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সওয়াব দান করেন।’ (বায়হাকি)।
- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার সেবা পাওয়ার সর্বাধিক হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা। অতঃপর তোমার রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়গণ যে যত নিকটবর্তী’।
- হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, তার নাক ধূলি ধূসরিত হৌক (৩ বার)। বলা হ’ল, তিনি কে হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে কিংবা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল, অথচ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না’।
- আল্লাহ তাআলা তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সব গুনাহই ক্ষমা করে থাকেন, একমাত্র পিতা-মাতার অবাধ্যতার গুনাহ ব্যতীত। (সুনানে তিরমিজি : ২৫১১; ইবনু মাজাহ : ৪২১১)
- আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমার মা ছিলেন মুশরিক। একদিন আমি তার নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি আমাকে রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলেন, যা আমার নিকট খুবই অপসন্দনীয় ছিল। তখন আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট গিয়ে কাঁদতে লাগলাম এবং তার হেদায়াতের জন্য দো‘আ করতে বললাম। অতঃপর তিনি দো‘আ করলেন। এরপর আমি বাড়িতে ফিরে এসে দরজা নাড়লে ভিতর থেকে মা বলেন, তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। তারপর তিনি গোসল সেরে পোষাক পরে দরজা খুলে দেন এবং কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করে তার ইসলাম ঘোষণা করেন।
- আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মুশরিক মা আমার কাছে এসেছে। আমি কি তার সাথে সদ্ব্যবহার করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। সদ্ব্যবহার কর’। ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, ঘটনাটি ছিল হোদায়বিয়া সন্ধি থেকে মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়কার। যখন তিনি তার মুশরিক স্বামী হারেছ বিন মুদরিক আল-মাখযূমীর সাথে ছিলেন (ফাৎহুল বারী)।
- জাহেমাহ আস-সুলামী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এলাম জিহাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পরামর্শ করার জন্য। তিনি আমাকে বললেন, তোমার কি পিতা-মাতা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন,الْزَمْهُمَا فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ أَرْجُلِهِمَا ‘তুমি তাদের নিকটে থাক। কেননা জান্নাত রয়েছে তাদের পায়ের নীচে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাহেমাহ আস-সুলামী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ডান দিক থেকে ও বাম দিক থেকে দু’বার এসে বলেন, আমি আপনার সাথে জিহাদে যেতে চাই এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাত কামনা করি। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমার মা কি বেঁচে আছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ارْجِعْ فَبَرَّهَا ‘ফিরে যাও। তার সাথে সদাচরণ কর’। অবশেষে তৃতীয় বার সম্মুখ থেকে এসে একই আবেদন করেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন তোমার মা কি জীবিত আছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,وَيْحَكَ الْزَمْ رِجْلَهَا فَثَمَّ الْجَنَّةُ ‘তোমার ধ্বংস হৌক! তার পায়ের কাছে থাক। সেখানেই জান্নাত’ (ইবনু মাজাহ হা/২৭৮১)।
- আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এসে বলল, আমি আপনার নিকটে হিজরত ও জিহাদের উপরে বায়‘আত করতে চাই। যার দ্বারা আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাত কামনা করি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, তোমার পিতা-মাতার কেউ জীবিত আছেন কি? লোকটি বলল, হ্যাঁ। বরং দু’জনেই বেঁচে আছেন। আমি তাদের উভয়কে ক্রন্দনরত অবস্থায় ছেড়ে এসেছি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এরপরেও তুমি আল্লাহর নিকট পুরস্কার আশা কর? লোকটি বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন,فَارْجِعْ إِلَى وَالِدَيْكَ فَأَحْسِنْ صُحْبَتَهُمَا فَفِيهِمَا فَجَاهِدْ ‘তুমি তোমার পিতা-মাতার নিকট ফিরে যাও ও সর্বোত্তম সাহচর্য দান কর এবং তাদের কাছেই জিহাদ কর’ (মুসলিম হা/২৫৪৯ (৫-৬)
- তিনি আরও বলেন,فَارْجِعْ إِلَيْهِمَا فَأَضْحِكْهُمَا كَمَا أَبْكَيْتَهُمَا، وَأَبَى أَنْ يُبَايِعَهُ ‘তুমি তাদেরকে হাসাও, যেমন তুমি তাদেরকে কাঁদিয়েছ। অতঃপর তিনি তার বায়‘আত নিতে অস্বীকার করলেন’। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, পিতা-মাতার সেবা কখনো কখনো জিহাদের চেয়ে উত্তম হয়ে থাকে। জমহূর বিদ্বানগণের নিকটে সন্তানের উপর জিহাদে যাওয়া হারাম হবে, যদি তাদের মুসলিম পিতা-মাতা উভয়ে কিংবা কোন একজন জিহাদে যেতে নিষেধ করেন। কেননা তাদের সেবা করা সন্তানের জন্য ‘ফরযে ‘আয়েন’। পক্ষান্তরে জিহাদ করা তার জন্য ‘ফরযে কিফায়াহ’। যা সে না করলেও অন্য কেউ করবে ইসলামী রাষ্ট্রের আমীরের হুকুমে।
- আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট কোন আমল সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, ওয়াক্ত মোতাবেক ছালাত আদায় করা। আমি বললাম, তারপর কি? তিনি বললেন, পিতা-মাতার সেবা করা। বললাম, তারপর কি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা’। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, পিতা-মাতার সেবা করার স্থান জিহাদে গমন করার উপরে।
- জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে আরোহণ করলেন। অতঃপর ১ম সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন। ২য় সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন। এরপর ৩য় সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনাকে তিন সিঁড়িতে তিন বার আমীন বলতে শুনলাম। তিনি বললেন, আমি যখন ১ম সিঁড়িতে উঠলাম, তখন জিব্রীল আমাকে এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি রামাযান মাস পেল। অতঃপর মাস শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাকে ক্ষমা করা হ’ল না। পরে সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। তুমি বল, আমীন। তখন আমি বললাম, আমীন’। ২য় সিঁড়িতে উঠলে জিব্রীল বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে বা তাদের একজনকে পেল। অতঃপর সে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করলো না। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। তুমি বল, আমীন। তখন আমি বললাম, আমীন’। অতঃপর ৩য় সিঁড়িতে পা দিলে তিনি বললেন, যার নিকটে তোমার কথা বর্ণনা করা হ’ল, অথচ সে তোমার উপরে দরূদ পাঠ করলো না। অতঃপর মারা গেল ও জাহান্নামে প্রবেশ করলো। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। তুমি বল, আমীন। তখন আমি বললাম, আমীন’।
- অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, তুমি তোমার মায়ের সেবা কর। فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ رِجْلَيْهَا ‘কেননা জান্নাত তার দু’পায়ের নীচে’ (নাসাঈ হা/৩১০৪)।
- আবু বাকরাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ কোনটি সে বিষয়ে খবর দিব না? আল্লাহর সাথে শিরক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। এসময় তিনি ঠেস দিয়ে ছিলেন। অতঃপর উঠে বসে বললেন, সাবধান! মিথ্যা কথা ও মিথ্যা সাক্ষ্য। কথাটি তিনি বলতেই থাকলেন। আমরা ভাবছিলাম, তিনি আর থামবেন না’।
- হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একবার জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার এমন কিছু আত্মীয়-স্বজন আছে, যারা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। কিন্তু আমি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করি এবং তাদের দুর্ব্যবহারে ধৈর্য্য ধারণ করি। উত্তরে তিনি বললেন, তুমি যা বলছ, সেরূপ হ’লে তুমি তাদের মুখের উপর গরম ছাই নিক্ষেপ করছ। যতক্ষণ তুমি এই নীতির উপর থাকবে, ততক্ষণ আল্লাহর পক্ষ হ’তে তোমার সাথে একজন সাহায্যকারী থাকবেন। যিনি তাদের ক্ষতি হ’তে তোমাকে রক্ষা করবেন’।
- আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ) হ’তে অন্য বর্ণনায় এসেছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ঐ ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষাকারী নয়, যে কেবল আত্মীয়তার বিপরীতে আত্মীয়তা করে। বরং সেই ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষাকারী, যে ব্যক্তি ছিন্ন হবার পরে তা পুনঃস্থাপন করে’।
- আবু উমামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘তিনজন ব্যক্তির কোন দান বা সৎকর্ম আল্লাহ কবুল করেন না : পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, খোটা দানকারী এবং তাক্বদীরে অবিশ্বাসী ব্যক্তি’।
- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ জান্নাতে সৎকর্মশীল বান্দার মর্যাদার স্তর উঁচু করবেন। তখন সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে এটা আমার জন্য হ’ল? তিনি বলবেন, ‘তোমার জন্য তোমার সন্তানের ক্ষমা প্রার্থনার কারণে’।
এজন্য সন্তানকে সর্বদা দো‘আ করতে হবে,رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيْراً- (রবিবরহাম্হুমা কামা রববাইয়া-নী ছগীরা) ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি দয়া কর যেমন তারা আমাকে শৈশবে দয়াপরবশে লালন-পালন করেছিলেন’ (ইসরা ১৭/২৪)।
পার্থিব জীবনে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে পিতা-মাতা হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে নিকটতম। আল্লাহ তাআলা তাদের হক সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে মাতা-পিতার যথাযথ হক আদায় করার তৌফিক দান করুন। (আমিন)
লেখকের মন্তব্যঃ
আশা করি পোস্ট টি থেকে আপনি অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছেন। পোস্ট টি হতে কোনো উপকার পেলে বা পোস্ট টি ভালো লাগলে পরিচিত দের সাথে সেয়ার করুন। আর আপনার কোনো সমস্যা বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না।আর এমন পোস্ট পেতে অবশ্যই আমাদের গুগলে ফলো করে রাখুন। কেননা আমরা প্রতিনিয়ত এমন পোস্ট করে থাকি। যা আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি তে ভূমিকা রাখবে।
ব্লগারের জিহাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন;
comment url