মহানবী (সাঃ) এর উপর ওহি অবতরণের পদ্ধতি
আল্লাহ তাআলা মানুষকে হেদায়েত দেওয়ার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসুল পাঠিয়েছেন। নবী রাসুল উপর এই ওহির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন হেদায়েতের বানী পাঠাতেন। মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন। সেই সাথে জীবনের নানা রকম সমস্যার সমাধানও তিনি বলে দিয়েছেন।
ওহির সংজ্ঞা
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর উপর অবতারিত বানীকে ওহি বলে।
ওহির প্রকারভেদ
ওহি দুই প্রকার। যথা:
- ওহি মাতলু (আল কুরআন)
- ওহি গায়বে মাতলু (আল হাদিস)
১. ওহি মাতলু
মাতলু অর্থ পঠিত যা পাঠ করা হয়। যে ওহীর ভাব, ভাষা, অর্থ, বিন্যাস, সকল কিছুই মহান আল্লাহর এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা হুবহু আল্লাহর ভাষায় প্রকাশ করেছেন, তাকে ওহি মাতলু বলে। এটিকে ওহি জলি বা প্রত্যক্ষ ওহি বলা হয়। কুরআন মাজীদ যেহেতু সালাতে তিলাওয়াত করা হয় তাই আল কোরআনকে ওহি মাতলু বা পঠিত ওহী বলে।
২. ওহি গায়রে মাতলু
গায়রে মাতলু অর্থ অপঠিত। যে ওহীর ভাব আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, কিন্তু রাসূল (সাঃ) নিজ ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন তাকে ওহি গায়রে মাতলু বলে। একে অহি খফি বা প্রচ্ছন্ন ওহি ও বলা হয়। রাসূল (সাঃ) এর হাদিস এ প্রকার ওহীর উদাহরণ। এটি সালাতে কেরাত হিসেবে তিলাওয়াত করা হয় না বলে এটিকে অপঠিত ওহী বলা হয়।
কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে প্রথম প্রকার ওহী কে কিতাব বা গ্রন্থ এবং দ্বিতীয় প্রকার ওহী কে হিকমাহ বা প্রজ্ঞা বলে অভিহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, "আল্লাহ মুমিনের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তার আয়াত সমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করেন, তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হিকমাহ তাদেরকে শিক্ষা দেন, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যেই ছিল।" (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৪)
দ্বিতীয় প্রকারের ওহি "হাদিস বা সুন্নত" নামে পৃথক ভাবে সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়েছে।
ওহি অবতরণের পদ্ধতি
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর উপর বিভিন্ন পদ্ধতিতে ওহি নাযিল হতো। প্রসিদ্ধ মতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর উপর ৭ পদ্ধতিতে ওহী নাযিল হয়েছে, যা নিচে আলোচনা করা হলো-
১. ঘন্টা ধ্বনির ন্যায়: ওটা ওহি নাযিলের প্রথম পদ্ধতি। রাসূলের নিকট অধিকাংশ সময় এ পদ্ধতিতে ওহী নাযিল হতো। ওহী নাযিলের পূর্বে প্রথমে বিরতিহীন ভাবে ঘন্টা ধ্বনির মতো শব্দ আস্তে থাকত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কানে শুনতেন।
এ সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম তীব্র শীতের মধ্যেও ঘর্মাক্ত হয়ে পড়তেন। তিনি আরোহী অবস্থায় থাকলে শক্তিশালী উটও ওহীর ভার বহন করতে না পেরে বসে পড়ত। ওহী নাযিলের এ পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর জন্য সবচেয়ে কষ্টকর ছিল।
হাদিসে আছে -হারিস ইবনে হিশাম (রা.) আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনার কাছে ওহি কি রূপে আসে? আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, কোনো কোনো সময় তা ঘণ্টাধ্বনির মতো আমার কাছে আসে। আর এটি-ই আমার ওপর সবচেয়ে বেদনাদায়ক হয় এবং তা শেষ হতেই ফেরেশতা যা বলে তা আমি মুখস্থ করে নিই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২)
২. মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতার আগমন: হযরত জিবরাঈল আলাইহি সাল্লাম কখনো কখনো মানুষের আকৃতিতে ওহী নিয়ে আসতেন। অধিকাংশ সময় বিশিষ্ট সাহাবী হযরত দাহিয়াতুল কালবি রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর আকৃতিতে জিবরাইল আলাইহিস সাল্লাম আগমন করতেন। এ পদ্ধতিতে ওহি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য তুলনা মূলক সহজ ছিল। হাদিসে এসেছে - আর কখনো কখনো আমার কাছে ফেরেশতা মানুষের আকৃতিতে আসতেন। (বুখারি)
সহিহ বুখারির হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিবরাইল (আ.) একজন পথিকের বেশে হাজির হন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ওহি কিভাবে আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আবার কখনো ফেরেশতা মানুষের রূপধারণ করে আমার সঙ্গে কথা বলে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২)
৩. জিবরাইল আলাইহি সাল্লাম এর নিজ আকৃতিতে আগমন: কখনো কখনো হযরত জিবরাঈল আলাইহি সাল্লাম অন্য কোন রূপ ধারণ না করে সরাসরি নিজ আকৃতিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর নিকট ওহি নিয়ে আগমন করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর জীবনে এরূপ ঘটনা তিনবার ঘটে।
প্রথমবার হেরা গুহায় কুরআনের প্রথম ওহী নিয়ে নিজ আকৃতিতে আগমন করেন। দ্বিতীয়বার মিরাজ রজনীতে, তৃতীয়বার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম জিব্রাইল আলাইহি সাল্লামকে আসল রূপে দেখার ইচ্ছা পোষণ করায় তিনি নিজ আকৃতিতে আগমন করেছিলেন।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘একবার আমি হাঁটছি, হঠাৎ আসমান থেকে একটা শব্দ শুনতে পেয়ে আমার দৃষ্টিকে ওপরে তুললাম। দেখলাম, সেই ফেরেশতা, যিনি হেরা গুহায় আমার কাছে এসেছিলেন, আসমান ও জমিনের মধ্যে একটি আসনে উপবিষ্ট। এতে আমি শঙ্কিত হলাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪)
৪. সত্য স্বপ্ন যোগে: মহানবীর প্রতি ওহী নাযিলের সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। কুরআন নাযিলের পূর্বে তিনি যা স্বপ্নে দেখতেন তাই ছিল ওহী। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর ওহীর সূচনা হয়েছিল ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। তিনি যখনই কোন স্বপ্ন দেখতেন, তা প্রত্যুষের আলোর ন্যায় বাস্তবে প্রতিফলিত হত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩)
অন্যান্য নবী-রাসুল (আ.)-ও স্বপ্নযোগে ওহি লাভ করতেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে পুত্র, নিশ্চয়ই আমি ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখেছি যে আমি তোমাকে জবাই করছি।’ (সুরা সফফাত, আয়াত : ১০২)
৫. আল্লাহ তায়ালার সরাসরি কথোপকথন: ওহি নাজিলের আর একটি পদ্ধতি ছিল, গণমাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে বাক্যালাপ। এই পদ্ধতি কে বলা হয় কালামে ইলাহি। মিরাজ রজনীতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম সরাসরি মহান আল্লাহর সঙ্গে বাক্যালাপ করেছেন। এ সময়ই উম্মতে মুহাম্মদির প্রতি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়েছে।
৬. সরাসরি হৃদয়পটে ওহি ঢেলে দেওয়া: হযরত জিবরাঈল আলাইহি সাল্লাম কখনো কখনো সামনে না এসে কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর অন্তরে আল্লাহর বাণী ফুঁকে দিতেন। এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বলেছেন, "হযরত জিব্রাইল আলাইহি সাল্লাম আমার মনসপটে ফুঁকে দিয়েছেন।"
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই ‘রুহুল কুদুস’ (জিবরাইল) আমার অন্তরে ঢেলে দিয়েছে যে কোনো ব্যক্তি মারা যায় না যতক্ষণ না তার জীবনকাল পূর্ণ হয় এবং সে পূর্ণ জীবিকা লাভ করে। (সহিহ আল-জামি, হাদিস : ২০৮৫)
৭. হযরত ইসরাফিল আলাইহি সাল্লাম এর মাধ্যমে ওহি প্রেরণ: কখনো কখনো আল্লাহ তায়ালা হযরত ইসরাফিল আলাইহি সাল্লামের মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ওহী নাযিল করতেন।
ওহীর গুরুত্ব
ওহির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ফরজ। এতে অবিশ্বাস বা সন্দেহ পোষণ করা কুফরি। ওহি মানব জাতির ইহকাল ও পরকালের শান্তি এবং কল্যাণের বার্তা নিয়ে আসে। এ বার্তা গ্রহণকারীর জন্য ওহী কল্যাণকর পথ সহজ করে দেয়। আর যারা ওহি কে অবিশ্বাস করে কিংবা অবজ্ঞা করে তাদের জন্য ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
হযরত আদম আলাইহি সাল্লাম থেকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম পর্যন্ত অগণিত নবী রাসুল আগমন করেছেন। নবী রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার মতো ওহীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক। ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মত পূর্ববর্তী নবীদের ওপর অবতীর্ণ ওহিকেও সত্যবাদী হিসেবে মেনে নেওয়া ঈমানের অংশ।
সুতরাং আমাদের সকলের উচিত ওহির প্রতি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস স্থাপন করা। আর সে অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করা।
লেখকের মন্তব্য
আশা করি পোস্ট টি থেকে আপনি অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছেন। পোস্ট টি হতে কোনো উপকার পেলে বা পোস্ট টি ভালো লাগলে পরিচিত দের সাথে সেয়ার করুন। আর আপনার কোনো সমস্যা বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না। আর এমন পোস্ট পেতে অবশ্যই আমাদের গুগলে ফোলো করে রাখুন।
কেননা আমরা প্রতিনিয়ত এমন পোস্ট করে থাকি। যা আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি তে ভূমিকা রাখবে। আমরা আমাদের জন্য নির্ভুল তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের আর্টিকেলে যদি কোন প্রকার ভুল থাকে তবে তা কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। এর ফলে আমরা পরবর্তীতে সে ভুল সংশোধন করতে পারবো এবং আপনাদের নির্ভুল ও সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারবো।
ব্লগারের জিহাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন;
comment url